বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, জনগণের নামেই সবকিছু হচ্ছে, তাদের কথা বলেই সবকিছু হচ্ছে, কিন্তু জনগণকে আমরা গণনার বাইরে ফেলে দিয়েছি। এখানে খুবই পরিষ্কার, জনগণ আর কোনো বিষয় নয়, দেশ কোন দিকে যাবে, কীভাবে পরিচালনা হবে, জনগণ কোনো বিষয় নয়।
বুধবার (২৩ জুলাই) এক গোলটেবিল বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ২২ জুলাই চার দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি এ কথা বলেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিলের আয়োজন করে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি দেখতে পাচ্ছি একধরনের বাংকার মেন্টালিটি আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। বাংকার মেন্টালিটি হয় তখন, যখন সবকিছু একটা নির্দিষ্ট লেন্স দিয়ে শুধু দেখা হয়, মানুষকে সহযোগী হিসেবে না দেখে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোকে নিয়েই চেষ্টা করা হয়। এখানে একই সঙ্গে এটাও বলা দরকার, পতিত সরকারের অনুশোচনাহীন সমর্থক গোষ্ঠীর দেশকে অস্থিতিশীল করার নানামুখী প্রচেষ্টা একটা বিরাট বিপদ হিসেবে সমাজের মধ্যে আছে বটে। কিন্তু বাংকার মেন্টালিটি দিয়ে এটা কোনো দিনও সমাধান করা যাবে না।
তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য ও কাগুজে ঐকমত্য প্রক্রিয়া মুখোমুখি অবস্থানে আছে। জাতীয় ঐক্য আসলে পেছনে পড়ে গেছে। জাতীয় ঐক্যের প্রতি মনোযোগ নেই। এই কাগুজে ঐকমত্যের প্রক্রিয়াটা জুলাই-আগস্টের জাতীয় ঐক্যের শক্তিটাকে আমরা পেছনে ফেলে দিয়েছি। কেতাবি যোগ্যতার একটা প্রচণ্ড সমাহার হয়েছে এবং একই সময়ে সক্ষমতার বিশাল ধস নেমেছে। কেতাবি যোগ্যতার সমাহার, একটা নির্দিষ্ট ধরনের আচরণ আর প্রকৃত সক্ষমতার ধস- এখানে আমরা একটা বড় ধরনের বৈপরীত্য দেখতে পাচ্ছি। মন্ত্রণালয়, নীতিনির্ধারণ, নেগোসিয়েশন প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা সক্ষমতার ধস দেখছি। কিন্তু ওই কেতাবি যোগ্যতার খুবই সরব ও খুবই প্রবল উপস্থিতি আছে। সেই অর্থে জনগণ গণনার বাইরে চলে গেছে। নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।
তিনি বলেন, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও বেকারত্ব এখানে যদি পাওনার হিসাব দেখি, এটা একটা ভয়াবহ অবস্থা। গত পরশুদিন তো ট্র্যাজেডি দেখলাম। কিন্তু সাধারণ সময়ে শিক্ষা ঘিরে যে আকাঙ্ক্ষাগুলো, সেখানে একটা ভয়াবহ বাস্তবতা আছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয়। এমন নয় যে কাঠামো নেই। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা প্রচণ্ড। নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, নির্যাতনকারীর অধিকাংশ হচ্ছে তরুণ।
তিনি বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত হয়তো একটা ধারণা ছিল যে, প্রাতিষ্ঠানিক ভিন্ন পথে আমরা এগোবার চেষ্টা করব। চেষ্টাও হয়তো ছিল। কিন্তু পরে নরমাল স্টেট ডাইনামিকস বুঝে গেছে যে বড় কিছু হবে না। ডিসেম্বরের পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি পূর্ণোদ্যমে আবার নিজেকে এসার্ট করেছে। হাসিনার পলায়ন এবং ওই সরকারের পতন, এটাতে আমাদের অবশ্যই একটা আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেটা একটা বাস্তবতা আছে বটে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রচণ্ডভাবে ফিরে এসেছে। আমলা কর্তৃত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে জেঁকে বসে আছে।
যে মানুষ পরিবর্তন এনেছিল, যাদের অংশগ্রহণে পরিবর্তন এসেছিল, তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এই গুটিয়ে নেওয়াটা একটা সিগনাল। এই গুটিয়ে নেওয়াটা সর্বকালের জন্য নয়। তারা দেখেছে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, তারা দেখছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও কথার ফুলঝুরির মারপ্যাঁচে আসলে চলছে অন্য ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের সঞ্চালনায় এই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, লেখক ও গবেষক মাহা মীর্জা, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের গবেষণা বিশেষজ্ঞ সহুল আহমদ প্রমুখ।
আমার বার্তা/এমই