মুন্সীগঞ্জে আলুচাষীদের লোকসান ঠেকাতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল আলুর জাত নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। আলুর সঠিক জাত নির্বাচন করা গেলে রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং এর বহুমুখী ব্যবহারও বাড়ানো যাবে। আলুর জাত নিয়ে নতুন এই গবেষণা রফতানিরও সুযোগ বাড়াবে এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণা টিম সোমবার (৬ অক্টোবর) বিভিন্ন এলাকার ১২ জন কৃষকের কেস স্টাডি করেছে। পরে গবেষণা টিম জেলা ও জেলার ছয় উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মুন্সীগঞ্জের কৃষকদের আলু উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণকে আরও উন্নত করার বিষয়ে নানা দিক উঠে আসে।
টিমের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কৃষি, অর্থনৈতিক ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম জানান, ‘মুন্সীগঞ্জের কৃষকরা আলু উৎপাদনে অত্যন্ত দক্ষ ও পরিশ্রমী। তবে গুণগত মানের বীজ, সার এবং বাজারজাতকরণে নানা সমস্যার কারণে তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’
আব্দুস সালাম আরও বলেন, ‘গত তিন বছর ধরে আলু নন-নোটিফায়েড ফসল হিসেবে রয়েছে। ফলে অনুমোদন নিয়ে বেসরকারি আমদানিকারকরা বিদেশ থেকে উন্নত জাতের বীজ এনে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে মুন্সীগঞ্জে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ‘ডায়মন্ড’ জাতের আলু চাষ হচ্ছে। এরপরই রয়েছে ‘সানশাইন’, ‘এস্টেরিক’, ‘সাগিট্টি’ ও ‘সিয়াশি’ জাতের আলু। এই অঞ্চলে প্রতি হেক্টরে গড়ে ২৮ থেকে ৩০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হচ্ছে, যা জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।’
কৃষকদের অভিজ্ঞতার উদ্ধৃতি দিয়ে এই গবেষক জানান, মানসম্মত বীজ সংগ্রহই এখন তাদের বড় সমস্যা। আমাদানি করা ৫০ কেজি বীজের কার্টনে প্রতি কেজির দাম ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত পড়েছে, যা অনেক কৃষকের নাগালের বাইরে।
আব্দুস সালাম আরও জানান, এক বিঘা জমিতে ২৭০ থেকে ৩০০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়, ফলে কেবল বীজের খরচেই কৃষকদের ব্যয় বেড়ে যায়। এরসঙ্গে যোগ হয় সার ও কীটনাশকের বাড়তি ব্যয়। এক বিঘা জমিতে আলু উৎপাদনের গড় খরচ ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাঁড়ায়। ‘কৃষকরা যদি উৎপাদিত আলু সঠিকভাবে বাজারজাত করতে না পারেন, তাহলে ক্ষতির মুখে পড়েন। কোল্ড স্টোরেজের অভাব ও সংরক্ষণ ব্যয় তাদের জন্য অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে।
আলুর বহুমুখী ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিল্পখাতে, পশুখাদ্য কিংবা মানুষের খাদ্যে আলুর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আলু থেকে চিপস, কুকিজ, ফ্লেক্সসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে।’
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া ও ভুটানসহ কয়েকটি দেশে আলু রফতানি করা হয়। তবে রফতানিকারকরা অর্থপ্রাপ্তি ও বীমা কাভারেজের ঝুঁকির মুখে পড়েন বলেও জানান তিনি।
পরিশেষে তিনি বলেন, ‘সরকার যদি আলু উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ, ভ্যালু অ্যাডিশন এবং রফতানির ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবে এবং দেশের আলু শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে।’
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা বারো কৃষকের সঙ্গে একটি মিটিং করেছি। আলু বর্তমানে নন-নোটিফায়েড হিসেবে রয়েছে, যদিও আগে এটি নোটিফায়েডে ছিল। নন-নোটিফায়েডে হওয়ায় কৃষকের জন্য এটি কতটা লাভজনক বা ক্ষতিসাধক তা এবং ভবিষ্যতে কী করা উচিত’ এই বিষয়ে কৃষকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘নোটিফায়েড বলতে বোঝায়- যে বীজ বা ফসলের জন্য সরকার কর্তৃক পারমিশন নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, পারমিশন ছাড়া বীজ বিক্রি করা হলে সেটি নন- নোটিফায়েড ক্রপ হিসেবে গণ্য হবে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের সঙ্গে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা কোনটা চাষ করা উচিত এবং কোনটা বেশি সুবিধাজনক।’
আমাদের জানা অনুযায়ী, এই এলাকায় একটি আলু প্রসেসিং ফ্যাক্টরি রয়েছে। কৃষকরা উল্লেখ করেছেন যে, বীজগুলো রফতানির যোগ্য এবং নোটিফায়েডে, সেগুলো চাষ করা জরুরি। এ ছাড়াও তারা আলোচনা করেছেন কীভাবে বিদেশে রফতানিযোগ্য বীজ তৈরি করা যায় এবং এতে কৃষক সমাজের ভূমিকা কী হতে পারে। যদিও সব উৎপাদিত আলু রফতানি করা সম্ভব নয়, তবে দেশের ভেতরে প্রসেসিং করার মাধ্যমে বিক্রি করা সম্ভব। এটিও তাদের একটি দাবি ছিল।
স্টার্চ সংরক্ষণ করা যায় ১০ বছর
গবেষকরা জানান, খাদ্য নিরাপত্তায় আলু হতে পারে অন্যতম খাদ্যশস্য। তাই গবেষকরা খাদ্যসংকট মোকাবিলায় আলুকে বেছে নিয়েছেন। বিশ্বের ১৫৯টি দেশে আলু চাষ হয়। এটি উপাদেয়, পুষ্টিকর এবং অধিক উৎপাদনশীল। আলুতে প্রচুর কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-৬, পটাসিয়াম এবং ফাইবার রয়েছে। আলুকে বলা হয় ‘কিং অব ভেজিটেবল’। হেক্টরপ্রতি আলুর গড় ফলন ২০ মেট্রিক টন; অন্যদিকে ধান ৩ মেট্রিক টন এবং গম ৩ দশমিক ৩ মেট্রিক টন। সুতরাং এই বিবেচনায় আলু অন্যান্য প্রধান ফসলের চেয়ে বেশ এগিয়ে। আর মুন্সীগঞ্জ জেলায় হেক্টর প্রতি আলুর গড় উৎপাদন ৩০ মেট্রিক টন।
হোয়াজং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলু নিয়ে গবেষণায় প্ল্যান বি হিসেবে আলুকে রেখেছে চীন। আলুর স্টার্চ হচ্ছে এটা থেকে তৈরি ময়দা বা আটা। অধ্যাপক ড. নি বিহুয়ার মতে, সাধারণ গম বা চালের আটা যেখানে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়, সেখানে আলুর স্টার্চ সংরক্ষণ করা যায় ১০ বছরের বেশি সময়। তাই খাদ্য নিরাপত্তার বলয় তৈরিতে তারা আলুকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
তাই কৃষকের গলার কাটা না করে আলুর বহুমুখী ব্যবহার এবং আলু রফতানি উপযোগী করে উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করা দরকার বলে মনে করেন এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
আমার বার্তা/এল/এমই