রোহিঙ্গা সংকটের শুরু মিয়ানমারে এবং মিয়ানমারেই রয়েছে এই সংকটের সমাধান। প্রায় আট বছর ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদেরকে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ত্রাণ ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে আসছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে গত ১৮ মাসে নতুন করে আরো প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে এবং এখনও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। নতুন আগত এই রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংকট বাড়ছে। আরাকান আর্মি রাখাইনে নিরীহ বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অমানবিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার আর্মি এবং আরসা সদস্যদেরকে সহযোগিতার অভিযোগ তুলে সাধারন রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন এবং রোহিঙ্গাদের স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ, ঘরবাড়ি ও দোকানপাট দখল করছে। চলমান পরিস্থিতিতে রাখাইনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশ ও অন্যান্য জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে। আরাকান আর্মির সদস্যদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিদ্বেষ ও তিক্ততা কমানোর কোন উদ্যোগ না নেয়াতে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতেও রোহিঙ্গাদের উপর আগের মতই নির্যাতন ও নিপীড়ন চলছে। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আরাকান আর্মি ও এন ইউ জির সাথে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের যোগাযোগ রয়েছে তাদের সহায়তায় এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। একই সাথে রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেরদেরকে প্রস্তুত করতে হবে ও অধিকার আদায়ের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গাদের মনে রাখতে হবে অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। এজন্য তাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
রাখাইনে ফেরত যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদেরকে সম্মানজনক জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রশিক্ষনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলা জরুরী। রাখাইনের উন্নয়নে অবদান রাখতে হলে এবং রাখাইনের নাগরিক হিসেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এবং একটা সম্মানজনক জীবন যাপনের জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। বিগত দিনগুলোতে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার লার্নিং সেন্টারের মাধ্যমে দুই লাখ পঁচিশ হাজার রোহিঙ্গা শিশুকে বার্মিজ কারিকুলামে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছিল। বর্তমানে তহবিল সংকটের ফলে ইউনিসেফ এসব লার্নিং সেন্টার চালাতে না পারার কারনে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্যাম্পের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। ক্যাম্প এলাকায় লার্নিং সেন্টারগুলো শিশুদেরকে একটি নিরাপদ পরিবেশ দেয়। মানবিক সংকটের সময়ে এই শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুদের মনে আশার সঞ্চার হয়, সেখানে তারা, নিয়মশৃঙ্খলা সম্পর্কে ধারনা পায়। রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোরদের স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠা ও মানসিক সুস্থতার জন্য এসব উদ্যোগ ইতিবাচক ভুমিকা রাখে। এই কার্যক্রমের পাশাপাশি আরাকানের ইতিহাস ও রোহিঙ্গাদের অতীত সম্পর্কেও জানানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে এই শিক্ষা কার্যক্রম যেন চলমান থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বর্তমানে রাখাইনেও স্বাভাবিক স্কুলের পাঠদান ব্যাহত হয়েছে, সেখানে রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয় গুষ্ঠির তরুণরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে মানবিক গুণাবলী বিকশিত হচ্ছে না এবং ঘৃণা ও নির্মমতা বেড়ে যাচ্ছে।
নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সাসাকাওয়া ইয়োহেই রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে মাছ চাষের সম্ভাবনা ও সুযোগ দেখে জেলেদের মাছ ধরার ক্ষেত্রে নৌকা ব্যবহার, মাছ চাষে দক্ষতা আনা এবং মাছ ক্রয়-বিক্রয়ে দক্ষতা বাড়াতে বলেন। নিপ্পন ফাউন্ডেশন রোহিঙ্গাদের আয় বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নতুন রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। রোহিঙ্গাদেরকে শিক্ষিত ও দক্ষ করতে এ ধরনের আরও দেশ ও সংস্থাকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সাধারন শিক্ষার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে অন্যান্য পেশায়ও দক্ষ করে গড়ে তোলার কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের বড় উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখবে না। রোহিঙ্গাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে বর্তমান উদ্যোগের পাশাপাশি বিদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ তথা রোহিঙ্গা ডায়াসফোরাকেও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের কোন জাতীয় নেতৃত্ব ও সংগঠন না থাকায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংগনে রোহিঙ্গার অধিকার ও স্বার্থ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না এবং রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নেতিবাচক ধারনা বেশী প্রচার পাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের কর্মকাণ্ড গুলোর ইতিবাচক দিক তুলে ধরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই সংকট নিরসনে সবাইকে অবহিত করতে হবে। একই সাথে তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত করার প্রক্রিয়া ও সুযোগ সৃষ্টি অত্যাবশ্যক। তাদেরকে নিজেদের সম্মান ও যোগ্যতা দিয়ে নিজেদেরকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। রোহিঙ্গা তরুণদের প্রতিভা রয়েছে, এই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেয়ার জন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। উপযুক্ত সুযোগ পেলে রোহিঙ্গারা তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে। অনেক রোহিঙ্গা তরুন তরুনী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে এবং তারা সেখানে ভাল করছে। শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। রোহিঙ্গারা আরাকানের উন্নয়নে অবদান রাখতে চায় তারা কারও বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। তাদেরকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে এমন কিছু প্রকল্প নেয়া দরকার যাতে তারা আত্মনির্ভরশীল ও দক্ষ হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমার ও রাখাইনে যে সব দেশের বিনিয়োগ রয়েছে তাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১৩ লাখ রোহিঙ্গার মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন টেকসই ও নিরাপদ করতে এসব কার্যক্রমের কোন বিকল্প নেই। রাখাইনে মানবিক সংকট এবং নিরাপত্তার অভাবেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে। রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের ফেরার জন্য অনুকূল নয়। সেখানে তাদের নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না । বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সাথে বিদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দের তেমন যোগাযোগ নাই, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সামনের দিনগুলোতে এই যোগাযোগ বাড়াতে হবে। রোহিঙ্গা নেতা ও বিদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতাদেরকে এন ইউ জি ও আরাকান আর্মির উর্ধতন নেতাদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার দূরত্ব কমানো এবং বিরাজমান নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিতে হবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তহবিল হ্রাস ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াসহ অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং সামনে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হতে পারে সে সব নিয়ে একটা অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ইউ এন এইচ সি আরের তথ্য মতে, আর্থিক সহায়তা কমে যাওয়ার কারনে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় তহবিল হ্রাসের প্রেক্ষিতে অগ্রাধিকারভিত্তিক বাজেট ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি, একই সাথে দক্ষতা উন্নয়ন ও বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি করতে হবে। দেশে ও বিদেশে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গনমাধ্যমকে ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে হবে। জাতিসংঘ, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশে বেশ তৎপর কিন্তু মিয়ানমারের ভেতরে তাদের তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান নয়। মিয়ানমারে থাকা ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে যাতে বাংলাদেশে আসতে না হয়, রাখাইনে তেমন পরিবেশ তৈরির জন্য জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। একই সাথে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিভিন্ন পর্যায়ের সমন্বয় বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি, এটি একটি অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে বর্তমান সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সংকট সমাধানের জন্য একটি বলিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক,কুটনৈতিক এবং জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলমান রেখেছে। রোহিঙ্গা সংকটের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে দল মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সংকট সমাধানে কাজ করতে হবে।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে কার্যকরী ও গঠনমূলক নেতৃত্বের অভাব, অন্তঃকোন্দল, বিভক্তি ও রাখাইনে নিবর্তনমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভেতরে দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দরকার যারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এবং বিভিন্ন মানবাধিকার ফোরামে তাদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরতে পারবে। আরসা বা আর এস ও’র নেতারা রোহিঙ্গাদের স্বার্থ না দেখে মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচার থেকে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত। তাদের কার্যক্রম থেকে এটাই বোঝা যায় যে তারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য উদ্যোগী নয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকার পরিস্থিতির প্রতিদিনই অবনতি হচ্ছে, মাদক ও মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে, যা উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, রোহিঙ্গাদের স্বার্থ ও অধিকার আদায় ও পরবর্তীতে রোহিঙ্গাদেরকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত নেতৃত্ব গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে তাদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের উদ্যোগে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক ঐক্য গঠন করার যে প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং আবশ্যক । চলমান এই সংকট সমাধানে টেকসই প্রত্যাবাসন এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঐক্যে ও দক্ষ নেতৃত্বের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।
আমার বার্তা/ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন/এমই