ঔষধশিল্পে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা এক বিস্ময়কর উন্নয়নের গল্পকথা, যা নিয়ে বাঙালী হিসেবে আমরা সকলে গর্ববোধ করি। বাংলাদেশের ঔষধ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং দেশের চাহিদা মিটিয়েও আমরা বিশ্ববাজারে নিজেদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি কোরতে সক্ষম হয়েছি। সফল উদ্যোক্তাদের মেধা, পরিশ্রম, কঠোর নীতিমালা অনুসরণসহ সর্বোপরি নীতিনির্ধারকদের সার্বিক সহায়তার ফলে বর্তমান সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই সফলতার গল্পের পেছনে এক বড় সত্য লুকিয়ে আছে। আমরা এখনও ঔষধের মূল উপাদান উৎপাদনে বড় ধরণের কোন সফলতা অর্জন কোরতে পারিনি। ফলশ্রুতিতে আমরা এখনও আমাদের ঔষধের মূল উপাদানের জন্য বিদেশের উপর নির্ভরশীল।
আমাদের ঔষধের প্রায় ৯৫% কাঁচামাল যাকে আমরা এপিআই (Active Pharmaceutical Ingredient) বলি এখনও বিদেশ থেকে আনতে হয়। এর সাথে আছে এক্সিপিয়েন্ট, যা ঔষধকে সঠিক আকার দেয়, স্থায়িত্ব বাড়ায়, বাইন্ডার হিসেবে কাজ করে বা ডিসইন্টিগ্র্যান্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই দুটি উপাদানের জন্য আমাদের প্রতি বছর খরচ করতে হয় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কাঁচামালের দামের অস্থিরতা বা সরবরাহ শৃঙ্খলে যেকোনো সংকট আমাদের পুরো ঔষধ উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
২০২০ সালে যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে লকডাউন ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। অনেক দেশ তাদের সীমানা বন্ধ করে দিল, ঔষধের আমদানি বন্ধ হয়ে গেলো। সেই মুহূর্তে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল - অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কতটা ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অনেক দেশই তখন নিজেদের ঔষধ ও এর কাঁচামাল উৎপাদনে জোর দিয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি করল: আমরা কি চাই আমাদের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা অন্য দেশের দয়ার উপর নির্ভর করুক? যদি আমরা নিজেদের এপিআই এবং এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদন করতে পারি, তাহলে জরুরি পরিস্থিতিতেও ঔষধের যোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অপার সম্ভাবনা। বিশ্বে এপিআই-এর বাজার আজ ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, আর এক্সিপিয়েন্টের বাজার প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। দুটি বাজারই দ্রুত বর্ধনশীল খাত। এখানেই আমাদের সুযোগ। আমরা যদি এই কাঁচামাল নিজেরাই তৈরি করতে পারি, তাহলে শুধু যে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে তাই নয়, আমরা পারি উচ্চমানের এপিআই এবং এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করতে। এটা হতে পারে আমাদের অর্থনীতির নতুন চালিকাশক্তি।
এই শিল্প বিকাশের সাথে সাথে প্রযুক্তির নতুন যুগ শুরু হবে। এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং গবেষণার উপর নির্ভরশীল। এর বিকাশের মাধ্যমে দেশে নতুন প্রযুক্তি আসবে, গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার পথ সুগম হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম উচ্চশিক্ষিত হয়ে এই শিল্পে অবদান রাখতে পারবে। এটি আমাদের ঔষধ শিল্পের সাপ্লাই চেইনকে আরও শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করবে। এছাড়াও, শিল্পখাতে শুধুমাত্র তৈরি পোশাক নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য উচ্চমূল্যের পণ্যের দিকে অগ্রসর হতে এটি সাহায্য করবে।
আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, সরকার ইতিমধ্যেই এপিআই শিল্প পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই পার্কগুলো দেশীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য এক আকর্ষণীয় সুযোগ তৈরি করবে, যেখানে এপিআই উৎপাদনের পাশাপাশি এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনের সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে। এটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে আরও কিছু সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদী নীতি সহায়তা এই শিল্পের বিকাশে এক স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে। এর সাথে, নির্দিষ্ট সময়ের (২০ বছর বা তারও বেশি) জন্য কর অবকাশ প্রদান করা, বিনিয়োগকারীদের জন্য এক বিশাল প্রণোদনা হতে পারে। এছাড়া, এই শিল্পের জন্য কম সুদে ব্যাংক ঋণ নিশ্চিত করা জরুরি, কারণ উচ্চ সুদে বড় আকারের বিনিয়োগ করা অনেক সময়ই কঠিন হয়ে পড়ে। এই ধরনের নীতি সহায়তা পেলে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা এপিআই এবং এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে আরও বেশি আগ্রহী হবেন। দ্রুত লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া এবং নীতিগত সহায়তা এই শিল্পের বিকাশে সহায়ক হবে।
হ্যাঁ, পথটা সহজ নয়। এপিআই এবং এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। এর জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ যা অত্যাধুনিক গবেষণাগার, উৎপাদন প্ল্যান্ট এবং দক্ষ জনবল তৈরিতে দরকার। উচ্চমানের এপিআই এবং এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনের জন্য উন্নত প্রযুক্তি এবং নিরন্তর গবেষণা ও উন্নয়নে জোর দিতে হবে। এই শিল্পের জন্য বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন গবেষক, প্রকৌশলী এবং প্রযুক্তিবিদ তৈরি করা জরুরি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমাদের সে ক্ষমতা আছে। বাংলাদেশের সামনে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের ঔষধ শিল্পের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, দক্ষ শ্রমিক এবং সরকারের ইতিবাচক মনোভাব এই যাত্রায় সহায়ক বলে প্রতীয়মান হয়।
এপিআই এবং এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে সফলতার জন্য আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট সংশ্লেষণ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর গবেষণা জোরদার করতে হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, বায়োটেকনোলজি এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরির উপর জোর দিতে হবে।
উৎপাদিত এপিআই এবং এক্সিপিয়েন্ট যেন আন্তর্জাতিক মান (যেমন GMP - Good Manufacturing Practices) বজায় রাখে, সেদিকে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। এতে কোনো ছাড় চলবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মানের বিষয়ে আপস করা যাবে না। বিদেশী বিনিয়োগকারী ও প্রযুক্তি সরবরাহকারীদের সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।
পরিশেষে, এপিআই এবং এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা কেবল একটি স্বপ্ন নয়, এটি এক বাস্তবতা যার জন্য আমরা প্রস্তুত। এটি আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বর্ম, আমাদের অর্থনীতির নতুন চালিকাশক্তি। সঠিক পরিকল্পনা, দৃঢ় সংকল্প এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারি এবং বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারি।
এই শিল্প বিকশিত হলে বাংলাদেশ শুধু ঔষধ উৎপাদনে নয়, ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনেও বিশ্ব মঞ্চে এক উল্লেখযোগ্য স্থান করে নেবে। এই যাত্রায় আমাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন - সরকারের, উদ্যোক্তাদের, গবেষকদের, এবং সর্বোপরি জনগণের। একসাথে আমরা গড়ে তুলতে পারি এমন একটি বাংলাদেশ যা হবে স্বাস্থ্যসেবায় স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী।
লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।
আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই