১০ অক্টোবর ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন
কমলাপুর, গেন্ডারিয়া, ভাঙ্গা জংশন পরিদর্শন করবেন রেলপথমন্ত্রী
স্বপ্নের পদ্মাসেতু দিয়ে রেল চলবে আগামী ১০ অক্টোবর। রেলযোগাযোগের মাহেন্দ্রক্ষণে সবুজ পতাকা নেড়ে শুভ উদ্বোধন করবেন জাতির স্বপ্ন সারথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন আগামীকাল কমলাপুর- গেন্ডারিয়া-ভাঙ্গা জংশন পরিদর্শন করবেন। এসময় তিনি নিরাপদ রেল যোগাযোগের বিষয়ে মতবিনিময় করবেন।সবকিছু ইতিবাচক করে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে রেলমন্ত্রীর এই পরিদর্শন কর্মসূচি বলছে রেলকর্তৃপক্ষ।
পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ বর্তমান সরকারের একটি মেগা প্রকল্প। সেতু দিয়ে সড়ক পরিবহন নিশ্চিত করার পরেই রেলযোগাযোগের কর্মসূচি সরকার হাতে নেয়। তারই সফল বাস্তবায়নের শেষ পদক্ষেপ সেতু দিয়ে রেল চালানো। এবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে মাঝে কয়েকটি দিন মাত্র।
জানা গেছে, আগামী ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতু দিয়ে রেল যোগাযোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর আগামীকাল ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা রুটে পরীক্ষামূলক চালানো হবে ট্রেন। এই রেলপথটি পুরোপুরি চালু হলে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের রেল যোগাযোগ সহজ হবে। এর মাধ্যমে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় যুক্ত হবে আরেকটি মাইলফলক। সেই সঙ্গে জিপিডিতে রাখবে বড় ভূমিকা।
এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত অংশটি আগামী ১০ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি পাইনি। তবে তারিখ চূড়ান্ত হয়েছে। চিঠি পেলে বিস্তারিত জানানো হবে। এর আগেই আগামীকাল ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হবে। এই অংশের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। তবে পুরো যশোর পর্যন্ত প্রকল্পের বাকি অংশ ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে বলে জানান তিনি।
বর্তমান সরকারের যোগাযোগ অবকাঠামোর আরেকটি মেগাপ্রকল্প-পদ্মা রেল সংযোগ। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। তবে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রকল্পের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এই অংশে ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইন বসানোর পুরো কাজ শেষ হয়েছে। তাই আগামীকাল ৭ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল করবে।
এদিন সকাল ৯টায় কমলাপুর স্টেশন থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে ট্রেন। এই ট্রেনে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন কমলাপুর থেকে মাওয়া, পদ্মা রেল সংযোগ ও ভাঙ্গা পর্যন্ত পরিদর্শন করবেন। ভাঙ্গা স্টেশনে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিং করবেন বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা রেল সংযোগসহ চারটি প্রকল্প আগামী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে উদ্বোধন করা হবে। এর মধ্যে দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প, খুলনা-মোংলা রেলপথ, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা অংশ ও আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্প। এর মধ্যে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ বাংলাদেশ ও ভারতের দুই দেশের অংশে নির্মাণ করা হয়েছে। তাই সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে রেলপথটি উদ্বোধন করবেন। এ ছাড়া দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প, খুলনা-মোংলা রেলপথ ও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের উদ্বোধনের সময় নির্ধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে আগামীকাল ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হবে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, এর আগে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা-মাওয়া পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়েছে। এবার ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতু পেরিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালানো হবে। এর জন্য চীন থেকে কেনা নতুন সাতটি কোচের সমন্বয়ে একটি বিশেষ ট্রেন প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই বিশেষ ট্রেনটি আগামী সাত সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় কমলাপুর স্টেশন থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। এই ট্রেনে মন্ত্রীপরিষদের সদস্য, স্থানীয় সংসদ সদস্য, রেলওয়ের কর্মকর্তারা ও গণমাধ্যমের কর্মীরা যাত্রী হিসেবে থাকবেন বলে সূত্রটি উল্লেখ করেছে।
এ বিষয়ে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে পরিচালক মো. আফজাল হোসেন জানান, ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। তবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে অথবা অক্টোবরের প্রথম দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত অংশটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখনো সময় নির্ধারণ করা হয়নি। ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত পুরো অংশে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এখনো শুধু কিছু স্টেশন ও সিগনালিংয়ের কাজ বাকি আছে।’ তাই আগামী সাত সেপ্টেম্বর ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হবে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণসহ পদ্মা সেতু রেল সংযোগের পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালে জুনের মধ্যে শেষ হবে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত তিনটি অংশে রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার মেইন লাইন, ঢাকা-গেন্ডারিয়া পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার ডাবল লাইন, লুপ, সাইডিং ও ওয়াই-কানেকশসসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৮৫ শতাংশ, মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৯৬ শতাংশ ও ভাঙ্গা-যশোর পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৭৫ শতাংশ। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিপিপি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বৃদ্ধি করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ২০২৪ সালে জুনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন দেয় একনেক সভা। জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পের অর্থায়নে করছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ সহায়তা দেবে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বাকি ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ টাকা ব্যয় হবে সরকারি ফান্ড থেকে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে চীনের সঙ্গে চূড়ান্ত ঋণ চুক্তি হয়। এর দুই বছর আগে কমার্শিয়াল চুক্তি হয়েছিল। প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি।
রেলপথের ২০ স্টেশন:
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত ২০টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৪টি স্টেশনই নতুন। পুরনো ছয়টি স্টেশনকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে । কেরানীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের নিমতলায় নতুন দুটি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর ও মাওয়া স্টেশন নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায় রয়েছে। মাওয়া স্টেশনের পরে পদ্মা সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরায় নির্মিত হচ্ছে ‘পদ্মা স্টেশন’। পদ্মা স্টেশনের পরে শরীয়তপুরে ‘শিবচর স্টেশন’। এ ছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গায় উন্নত দেশের আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে জংশন। ভাঙ্গা থেকে একটি লুপ লাইন ফরিদপুর সদর ও অন্য একটি লুপ লাইন নাগরকান্দা পর্যন্ত যাবে।
প্রকল্পের আওতায় নাগরকান্দায় স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এরপরে গোপালগঞ্জের মকসুদপুর ও মহেশপুরে নির্মিত হবে দুটি রেলস্টেশন। এ ছাড়া নড়াইলের লোহাগড়া, নড়াইল সদরে একটি করে স্টেশন নির্মাণ করা হবে। যশোরের জামদিয়া ও পদ্মবিলে দুটি নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হবে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান। প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান ছয়টি রেলস্টেশন ঢেলে সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। এ ছাড়া গেন্ড-ারিয়া ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন নান্দনিক করে গড়ে তোলা হবে। সংস্কার করা হবে তিনটি স্টেশন। সেগুলো হলো, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি, যশোরের সিংগাই ও রুপদিয়া স্টেশন। বিদ্যমান এসব স্টেশন নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলা হবে।
কমলাপুর থেকে গেন্ডারিয়া তৃতীয় ডুয়েলগেজ লাইন, ভাঙ্গা জংশনে ওভারহেড স্টেশন, কমলাপুরের টিটিপাড়ায় আন্ডারপাস, নড়াইলের তুলারামপুরে নতুন আন্ডারপাস এবং ভাঙ্গা স্টেশনে আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। যেসব স্টেশনে আন্ডারপাসের মাধ্যমে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যাওয়া যাবে। মাওয়া, পদ্মবিল, কাশিয়ানি, রূপদিয়া স্টেশনগুলোতে অপারেশনাল সুবিধা বাড়ানো হবে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
এবি/ জেডআর