ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবসান নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে। এ নিয়ে আলাস্কায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে বিরল বৈঠক হয়েছে। গতকাল সোমবার হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গেও ট্রাম্পের বৈঠক হয়েছে। এই আলোচনায় মূল কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দনবাস এলাকা। দীর্ঘদিন ধরেই এই এলাকায় নজর দিয়েছে রাশিয়া। বর্তমানে রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইউরোপীয় নেতারা এবং রাশিয়ার মধ্যে স্পষ্ট বিভেদ রয়ে গেছে। সোমবারের কূটনৈতিক আলোচনার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এই আলোচনায় ভূমি অদলবদল অথবা দখল ছেড়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠে আসছে বারবার। ইউক্রেনীয়রা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে তাঁরা এক ইঞ্চি মাটিও ছাড়তে রাজি নন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের চাপে সেই অবস্থান শেষ পর্যন্ত নেতারা ধরে রাখতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক—এই দুটি অঞ্চল একত্রে দনবাস নামে পরিচিত। সোভিয়েত যুগে এটি ছিল কয়লাখনি ও ইস্পাত কারখানার এক বিশাল শিল্পাঞ্চল। তবে দনবাস অঞ্চলে উর্বর কৃষিজমি, গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদী এবং আজভ সাগরের উপকূলও রয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে, দনবাস ইউক্রেনের সবচেয়ে বেশি ‘রুশ’ অধ্যুষিত অংশ। এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রুশভাষী মানুষ বাস করে। প্রায় ১০ বছর আগে সিএনএনের এক সাংবাদিক এই অঞ্চলে একাধিক সফর করেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, সেখানকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের মধ্যে ইউক্রেন সরকারের প্রতি তেমন একটা আগ্রহ বা ভালোবাসা নেই। এই অঞ্চল থেকে কিয়েভ বেশ দূরে।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর পুতিন এই দনবাস অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই ইউক্রেনকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা শুরু করেন। রুশপন্থী মিলিশিয়ারা, যাদের মধ্যে কেউ কেউ ট্যাঙ্কসহ সুসজ্জিত, দ্রুত লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক শহর দখল করে নেয়। সেই সময় ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ছিল অপ্রস্তুত এবং দুর্বল।
ইউক্রেন সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় আট বছর ধরে এই দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ইউক্রেনীয় বাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই চলে। এতে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। ২০১৪ সাল থেকে কমপক্ষে ১৫ লাখ ইউক্রেনীয় দনবাস ছেড়ে চলে গেছেন এবং অনুমান করা হয়, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এখনো রাশিয়ার দখলে থাকা অঞ্চলে বাস করছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদী-নিয়ন্ত্রিত দনবাস অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে কয়েক লাখ জনকে রুশ পাসপোর্ট বিতরণ করেছে রাশিয়া।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণ মাত্রার আক্রমণের আগের রাতে পুতিন দাবি করেন, তথাকথিত ‘সভ্য বিশ্ব’ দনবাসে ৪ কোটি মানুষের ওপর চালানো ‘ভয়াবহ গণহত্যাকে’ উপেক্ষা করছে। এরপর তিনি লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ওই বছরের শেষের দিকে, মস্কো একতরফা গণভোটের মাধ্যমে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে নেয়। যদিও তখনো এই অঞ্চলগুলোর কিছু অংশ তাদের সম্পূর্ণ দখলে ছিল না।
ক্রেমলিনের কাছে, দখল করা ভূমি থেকে সরে আসার চেয়ে, যে অঞ্চলগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে মিশে গেছে, সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। বিশেষ করে পুতিনের মতো একজন নেতার জন্য, যিনি ‘বৃহত্তর রাশিয়া’ গড়ার ধারণায় মগ্ন। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার বর্তমান অগ্রগতির হার অনুযায়ী, সম্পূর্ণ দনবাস অঞ্চল দখল করতে তাদের আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। একই সঙ্গে, ইউক্রেনের পক্ষেও ইতিমধ্যে হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা কঠিন: তারা প্রায় পুরো লুহানস্ক এবং দোনেৎস্কের ৭০ শতাংশের বেশি এলাকা হারিয়েছে।
স্লাভিয়ানস্ক, ক্রামাতোরস্ক এবং কস্তিয়ানতিনিভকার মতো শিল্প শহর, রেললাইন ও সড়কগুলোকে ঘিরে যে ‘দুর্গ’ ইউক্রেন ধরে রেখেছে, তা পুতিনের বাহিনীর জন্য একটি বড় বাধা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির জন্য দোনেৎস্কের অবশিষ্ট অংশ ছেড়ে দেওয়া রাজনৈতিকভাবে আত্মহত্যার শামিল হবে। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির মতে, ইউক্রেনীয়দের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ রাশিয়ার কাছে কোনো ভূমি ছেড়ে দেওয়ার বিপক্ষে।
জেলেনস্কি বারবার উল্লেখ করেছেন, দোনেৎস্কের অবশিষ্ট অংশ থেকে পিছু হটলে তা মধ্য ইউক্রেনের বিশাল উন্মুক্ত সমভূমিকে পরবর্তী রুশ আক্রমণের জন্য অরক্ষিত করে তুলবে। এ ছাড়া, এটি ইউক্রেনের সংবিধান অনুযায়ী ভূমির অসাংবিধানিক আত্মসমর্পণ বলে বিবেচিত হবে। দনবাস, যা ২০১৪ সালেও ছিল, এখনো পুতিনের ইউক্রেন দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম-ভিত্তিক শৃঙ্খলার জন্য এটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার জায়গা।
আমার বার্তা/এমই