আইফেল টাওয়ারের চেয়ে উঁচু একটি রেলসেতু তৈরি করেছে ভারত। জম্মু ও কাশ্মীরের চেনাব নদীর ওপর নির্মিত এই রেলসেতুর উচ্চতা ভূমি থেকে ৩৫৯ মিটার (আইফেল টাওয়ার ৩৩০ মিটার)। সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার। আর এই সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি রুপি। আজ শুক্রবার জম্মু ও কাশ্মীর সফরে গিয়ে ‘চেনাব রেলসেতু’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরে এটিই ছিল তাঁর প্রথম সফর।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চেনাব রেল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে উদমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেললাইন প্রকল্পের অংশ হিসেবে। ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের মাধ্যমে কাশ্মীরকে দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সরাসরি রেলপথে যুক্ত করা হয়েছে। পুরো ২৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই লাইনটিতে রয়েছে ৩৬টি সুড়ঙ্গ ও ৯৪৩টি সেতু।
২০০২ সালে এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তবে সেতু তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে। ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হয় সেতু তৈরির কাজ। পরের বছরই নতুন সেতুর ওপর রেলপথ তৈরির কাজ শুরু হয়। এক বছর পর অর্থাৎ ২০২৪ সাল থেকে চেনাব সেতুর ওপরে শুরু হয় রেলের ট্রায়াল রান। চলতি বছর জানুয়ারি মাসেই সফলভাবে এই সেতুর ওপরে ট্রায়াল রান শেষ করে বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। এখন থেকে চেনাব ব্রিজ ও সেখানে অবস্থিত রেলপথের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ হবে শ্রীনগর ও কাটরার। নতুন এই লাইনে চলবে এক জোড়া বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। এর ফলে শ্রীনগর থেকে বৈষ্ণোদেবী মন্দিরের নিকটবর্তী কাটরা স্টেশনে যাওয়া যাবে মাত্র তিন ঘণ্টায়।
চেনাব সেতু একটি স্টিল আর্চ বা ধনুকাকৃতির নকশায় তৈরি, যা প্রকৌশলীদের জন্য ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে কনকন রেলওয়ে করপোরেশন এবং নির্মাণ করেছে আফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার, দক্ষিণ কোরিয়ার আলট্রা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ভারতের ভিএসএল ইন্ডিয়া।
সেতুটির নকশা ও ভিত্তি তৈরিতে কাজ করেছে ভারতের আইআইটি, ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসআই), ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও), ফিনল্যান্ডের ডব্লিউএপি গ্রুপ ও জার্মানির লিওনার্ড অ্যান্ড্রার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
কাশ্মীরের কঠিন ভূপ্রকৃতি, তীব্র তাপমাত্রা ওঠানামা, উচ্চগতির ঝোড়ো হাওয়া ও ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল হওয়ায় এটি নির্মাণ ছিল অত্যন্ত কঠিন। সেতুটিকে ভূমিকম্প ও প্রবল বাতাসের ধাক্কা সামাল দেওয়ার মতো করে নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণে এটিকে প্রকৌশল জগতের এক অনন্য অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের রিয়াসি জেলার চন্দ্রভাগা নদীর নির্মিত এই ব্রিজটি স্টিল ও কংক্রিট দিয়ে এমনভাবে তৈরি, যা রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকবে। বড়সড় বিস্ফোরণেও তেমন ক্ষতি হবে না এই সেতুর।
চেনাব সেতু ও উদমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেললাইন প্রকল্প কাশ্মীরের পর্যটন, কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর পর্যটন খাতে যে ভাটা নেমেছিল, এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো তা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি এই দিন শ্রীনগর-কটরা বন্দে ভারত এক্সপ্রেসেরও উদ্বোধন করেন। এটি কাশ্মীরে প্রথম আধুনিক উচ্চগতির ট্রেন। এই ট্রেনগুলোতে রয়েছে হিটিং প্যাড, গরম পানির পাইপলাইন এবং বরফ প্রতিরোধী জানালার কাচ—যা অঞ্চলটির কড়া শীত উপযোগী। উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহা ও রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবও উপস্থিত ছিলেন।