কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার ও তাঁর মাকে হত্যার মূল আসামী মাওলানা মোবারক করিম সিদ্দিকীকে (৩২) গ্রেপ্তার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। পেশায় তিনি একজন কবিরাজ। এবার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তার সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা।
২০২৩ সালের ২৪ জুন কুমিল্লা নগরীর ধর্মপুর পশ্চিম চৌমুহনীতে অবস্থিত হযরত খাদিজাতুল কোবরা মহিলা মাদ্রাসা ও এতিমখানার একটি কক্ষে মোহনা আক্তার মুন্নী নামের ৭ম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ চেষ্টা করেন। ধর্ষণে বাঁধা দেওয়ায় ওই শিক্ষার্থীকে সেই সময় ধারালো ছুরি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে সেই কক্ষে তাঁর কাছ থেকে পানি পড়া নিতে এক নারী আসলে এই ছাত্রী দৌড়ে পালিয়ে যায়। ওই মাদ্রাসার মুহতামিম ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোবারক। মাদ্রাসার একটি বাসাতেই বউ বাচ্চাসহ বাস করতেন তিনি। পাশের গলিতে ছিল তার শশুর বাড়ি।
একইদিনে মুন্নীর আরেক সহপাঠী মীমকেও ধর্ষণের চেষ্টা করেন এই কবিরাজ। স্থানীয় সালিশের পর এই পরিবার সামাজিক হেনস্তা থেকে বাঁচতে এলাকা ছেড়ে অন্যাত্র চলে যান।
মুন্নী তাঁর বাড়িতে গিয়ে ঘটনা বাবা মাকে বললে তাঁরা ও মীমের পরিবার স্থানীয় দক্ষিণ দূর্গাপুর চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানায়। তিনি ন্যায় বিচার না করে এক লাখ টাকা জরিমানা নিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে দেন বলে অভিযোগ করেন পরিবার৷ পরে সঠিক বিচার না পেয়ে ১২ জুলাই ২০২৩ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল ১ নং আদালতে একটি মামলা করেন ওই মুন্নীর পরিবার।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ঘটনার দিন আসামীর স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে পিতার বাড়ীতে গেলে সে মুন্নিকে তার কক্ষে যেতে বলে। এরপর মুন্নী সেখানে গেলে সে তাকে ঝাপটিয়ে ধরে নির্যাতন ও ধর্ষণ চেষ্টা করে। ওই ছাত্রী চিৎকার করতে চাইলে তার মুখ চেপে ধরে এবং পরনের কাপড় খুলে ফেলে। তার চিৎকার থামাতে না পেরে আসামী ছুরি দিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। এবং এই ঘটনা যদি বাইরের কাউকে বলে তাহলে তার বাবা মাকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়।
এরপর ওয়ারেন্ট হয়ে গেলে আটকের ভয়ে আসামি ওমরা হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান। সেখানে গিয়ে ওমরা শেষে দেশে ফিরে না এসে অবৈধভাবে সৌদিতে অবস্থান করেন। এরপর পুলিশের কাছে দুই বছর আটক থাকার পর গত জুলাই মাসে দেশে ফিরে আসেন।
এই মাদ্রাসাটি একটি আবাসিক মাদ্রাসা ছিল। ২০২২ সালে হাবিবা নামের আরেক আবাসিক শিক্ষার্থীকেও ধর্ষণের চেষ্টা করেন। পরে তাদেরকেও টাকা পয়সা দিয়ে অন্যাত্র চলে যেতে বলে। এছাড়াও আরেকটি মেয়ের সাথেও তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল। এটা তার স্ত্রী জেনে যাওয়ার পর সে স্ত্রীকে মারধর করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রায় তিন বছর ধরে তিনি কবিরাজী পেশায় জড়িত বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী। বদরপুর মাদ্রাসার কবিরাজ ও পীর ইলিয়াস শাহ থেকে এসব আয়ত্ত্ব করেছেন। কুফরী কালাম, কালো জাদু, বশীকরণ, ঝাড়ফুঁক এসবে ভালো দখল ছিল তার। এবং এটা অনেক উপকারী ছিল। বন্ধ্যা, বিয়ে না হওয়া, বিবাহ বিচ্ছেদ, মেয়েদেরকে বশ করা এসব তদবির করতেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। কুমিল্লার অনেক প্রভাবশালী এমপি, চেয়ারম্যানও চিকিৎসা নিতে তার এই বাসায় আসতেন। যে কারণে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা তাকে সেল্টার দিতেন।
মাদ্রাসার আশেপাশের বেশ কয়েকজন স্থানীয় লোকের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
মোবারকের ছাত্রী তাহমিনা আক্তার অপি বলেন, উনি ভালো মানুষ ছিল না। মেয়ে পটানো কালোজাদু করতো। আমি অনেক দেখছি। উনার চিকিৎসা নেওয়ার জন্য অনেক রাজনৈতিক নেতারাও আসতো। তাঁরা উনাকে চালের বস্তা, তেল, চিনি থেকে যাবতীয় সব কিছু দিতো। স্থানীয় এক নেতা একবার তার চিকিৎসায় উপকার পেয়ে তাকে এক হাজার ইট উপহার দেয়। উনার বউয়ের সাথেও উনার ভালো সম্পর্ক ছিলো না। ২০২১ সালে বউ একবার পুলিশ নিয়ে আসছিল৷ বউ বাবার বাড়ি যাওয়ার পর বাসায় অন্য মেয়ে নিয়ে আসতো। উনার ফাঁসি হোক আমরা এটা চাই।
মাদ্রাসার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা হাসিনা বেগম বলেন, আমি উনাকে বিশ্বাস করে তার শশুর বাড়ির লোকজনের অনুরোধে মাদ্রাসা করার জন্য বাসা ভাড়া দিয়েছি। প্রথমদিকে উনি এদিক সেদিক থেকে সাহায্য নিয়ে মাদ্রাসা চালাতেন। কিন্তু কিছুদিন পরে মাদ্রাসায় সিসিটিভি, এসি, ফ্রিজ সব নিয়ে আসছে। নিজের জন্য একটা মোটরিসাইকেলও কিনছে। কুফরী আর কালোজাদু করেই এতো টাকা আয় করছে উনি। আর উনার এসবে কাজ হতো তাই অনেক মানুষ আসতো। অল্পদিনের মধ্যেই উনার অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেছে।
মুন্নীর মা বিউটি বেগম বলেন, আমার মেয়েকে অনেক জোরাজোরি করছে ধর্ষণ করতে। এক মহিলা ওর কাছে কবিরাজির জন্য তখন আমার মেয়ে দৌড় দিয়ে পালিয়ে আসছে। উনি আমার মেয়েকে রুমে ডাকে। এরপর সিসিটিভি বন্ধ করে দিয়ে এসব করে। আমরা স্থানীয় সালিশে বিচার না পেয়ে মামলা করি। এরপর মামলা উঠানোর জন্য সে ও তার শশুর বাড়ির লোকজন আমাদের নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে।
ফাতেমা নামের আরেকটা মেয়ের সাথেও এমন করছে। পরে এটা জানাজানি হওয়ার পর তার পরিবারকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে এলাকা থেকে চলে যেতে বলে। এরপর তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
মোবারকের স্ত্রী সুমাইয়া বলেন, উনি হত্যাকারী কিনা আমি জানিনা। পুলিশ হত্যার পরে আমার মোবাইল ফোনও নিয়ে গেছে। উনি মেয়েদের নিয়ে এসব করে জানতে পারার পরে আমি উনাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু আমার ছোট দুইটা মেয়ে আছে ওদের দিকে তাকিয়ে ডিভোর্স দেইনি।
মোবারকের শাশুড়ী বলেন, আমার দুইটা মেয়েকে ড্রাইভার দেখে বিয়ে দিছি। কিন্তু আমাদের তো কবরে যেতে হবে, মরতে হবে তাই এই মেয়েটাকে হুজুর দেখে বিয়ে দিছি কিন্তু হুজুর যে এমন অমানুষ হবে কে জানতো।
মোবারকের বাড়ি দেবিদ্বারের কাবিলপুর গ্রামে। সেখানে যাওয়ার পর জানা যায়, সে নূরানী পর্যন্ত গ্রামের একটি মাদ্রাসায় পড়েছেন। এরপর সে বদরপুর মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। এখানেই সে কবিরাজি আয়ত্ত্ব করেন। পরিবারের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না।
তার বড় ভাই মো: সুজন বলেন, আমার ভাই আগে এমন ছিল না। ইলিয়াস শাহ আমার ভাইকে নষ্ট করছে। আমার ভাই যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে আমি চাই ওর শাস্তি হোক। আর যদি সে নির্দোষ হয় তাহলে এর পিছনে যারা আছে তারা আটক হোক। সত্য সব সময় জয়ী হবে।
একজন ধর্ষণ চেষ্টার পলাতক আসামীকে কেন এতোদিনেও আটক করা হয়নি জানতে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খাঁনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এএসপি মোহাম্মদ সাইফুল মালিক বলেন, এমন একটা ঘটনা শুনেছি মামলা হয়েছে কিনা সেটা আমরা জানি না। আর এটা তো প্রিভিয়াস ইস্যু এটা কেন আসবে এখন।
মামলার পিপি এডভোকেট হারুনুর রশিদ সবুজ বলেন, এই মামলায় আসামীর ওয়ারেন্ট হয়েছে। এরপর থেকেই সে পলাতক। এটা একটা নারী নির্যাতন মামলা।
আমার বার্তা/বুশরা আক্তার/জেএইচ