দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় দক্ষিণ এশিয়া একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এ অঞ্চলের দুই পরাশক্তি—ভারত ও পাকিস্তান—অতীতের বিভাজনের যন্ত্রণা, রাজনৈতিক সংঘাত এবং সীমান্ত বিরোধের জটিলতার কারণে বারবার যুদ্ধ ও উত্তেজনার মুখোমুখি হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পারস্পরিক দোষারোপ, কাশ্মীর ইস্যু, জঙ্গি হামলা এবং পরমাণু শক্তির প্রদর্শনী নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে উসকে দিচ্ছে। এই যুদ্ধাশঙ্কা শুধু ভারত-পাকিস্তান সীমাবদ্ধ নয়, বরং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে করে তুলছে অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভিত্তি হলো ১৯৪৭ সালের বিভাজন, যার ফলে তৈরি হয়েছিল দুই স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। বিভাজনের সময় লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, ঘটে জাতিগত সহিংসতা। সেই ক্ষত আজও সম্পূর্ণ শুকায়নি। ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি তিনটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এছাড়া ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ, সীমান্তে নিয়মিত গোলাগুলি এবং জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ পরিস্থিতিকে প্রায় যুদ্ধাবস্থায় নিয়ে এসেছে বহুবার।
কাশ্মীর প্রশ্ন হলো ভারত-পাকিস্তান বিরোধের মূল উৎস। উভয় দেশই সম্পূর্ণ কাশ্মীরকে নিজেদের দাবি করে থাকে। যদিও ভারত অধিকাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করে আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল। ২০১৯ সালে ভারতের সংবিধান থেকে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করা হলে পাকিস্তান তা আন্তর্জাতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে। এরপর থেকেই দু’দেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে ঠেকে। পাকিস্তানের দৃষ্টিতে এটি ছিল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, আর ভারতের মতে এটি ছিল অভ্যন্তরীণ বিষয়।
দুই দেশের পরমাণু অস্ত্রধারী হওয়া যুদ্ধের হুমকিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। ১৯৯৮ সালে উভয় দেশ পরমাণু পরীক্ষা চালিয়ে নিজেদের পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে আজ যদি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়, তবে তা হয়তো সীমান্তভিত্তিকই থাকবে না, বরং পারমাণবিক যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে—যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বে। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমিত পারমাণবিক যুদ্ধ হলেও তাতে কয়েক কোটি মানুষ নিহত হতে পারে, খাদ্য সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পুরো দক্ষিণ এশিয়া দুর্ভিক্ষ ও বিপর্যয়ে পতিত হতে পারে।
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আসছে। বিশেষ করে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা, পাঠানকোট হামলা, উরি ও পুলওয়ামা হামলার পর ভারত বারবার অভিযোগ করেছে যে এই হামলাগুলো পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম। এর পাল্টা হিসেবে পাকিস্তান দাবি করেছে, ভারত বালোচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকে দিচ্ছে।
এই পারস্পরিক সন্দেহ ও আক্রমণের ভাষা যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে। পুলওয়ামা হামলার জবাবে ভারতের বালাকোটে বিমান হামলা এবং তার পরদিন পাকিস্তানের পাল্টা হামলা বিষয়টিকে সরাসরি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধাশঙ্কা শুধু এই দুই দেশেই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান এবং চীনসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়। যুদ্ধ হলে উদ্বাস্তু সমস্যাও দেখা দিতে পারে, সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে। SAARC-এর মত আঞ্চলিক সংগঠনগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে।
বাংলাদেশের মতো দেশ, যাদের সঙ্গে উভয় দেশেরই কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে, তারাও পড়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। ভারত যদি নিজের নিরাপত্তার অজুহাতে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, তবে তা বাংলাদেশের অর্থনীতি, রপ্তানি ও শ্রমবাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতির পেছনে রয়েছে পারস্পরিক আস্থার অভাব এবং কূটনৈতিক উদ্যোগের অপ্রতুলতা। উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগকে ব্যবহার করে যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে উসকে দেন। নির্বাচন এলেই পাকিস্তানকে শত্রু হিসেবে দেখানো হয় কিংবা ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, যাতে ভোটারদের আবেগকে প্রভাবিত করা যায়।
এর পাশাপাশি চীন, রাশিয়া ও আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, আবার ভারত ও আমেরিকা এখন কৌশলগত অংশীদার। এই প্রেক্ষাপটে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মানেই বড় পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ হওয়া।
যুদ্ধের জন্য উভয় দেশই প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে প্রতিরক্ষা খাতে, যা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়নের তুলনায় অনেক বেশি। অথচ এই অঞ্চলেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও শিক্ষাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী। যুদ্ধের কারণে এই জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ বাড়বে বহুগুণ।
মানবিক বিপর্যয়ও অনিবার্য। হাসপাতাল, স্কুল, রেলপথ, সেতু ধ্বংস হবে; সাধারণ নাগরিকেরা হয়ে পড়বে গৃহহীন, উদ্বাস্তু এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। একবার যুদ্ধ শুরু হলে তা কতদূর বিস্তৃত হবে, তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না।
যুদ্ধ নয়, সংলাপ ও সহযোগিতার পথেই রয়েছে ভবিষ্যৎ। উভয় দেশের উচিত পরস্পরের ওপর আস্থা সৃষ্টি করা, তথ্য ও গোয়েন্দা বিনিময় করা, সন্ত্রাসবিরোধী সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক গড়ে তোলা। নদী, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য দূরীকরণ—এসব ইস্যুতে যৌথ পদক্ষেপ নিলে দুই দেশের জনগণ উপকৃত হবে।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার উচিত দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করা এবং যুদ্ধ উস্কে দেওয়ার চেষ্টাকে রুখে দেওয়া। আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যদি নিরপেক্ষভাবে আলোচনার পথ প্রশস্ত করে, তবে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের হুমকি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এটি কেবল রাজনৈতিক বিরোধ নয়, বরং এটি একটি মানবিক ও আঞ্চলিক সংকট। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের চেয়ে শান্তির টেবিল অনেক বেশি কার্যকর, স্থায়ী ও মানবিক। দুই দেশকেই বুঝতে হবে—বোমা নয়, বুকের পাঁজরে গাঁথা বিশ্বাসই পারে সত্যিকার বিজয় এনে দিতে। শান্তি, সহনশীলতা ও কৌশলগত ধৈর্য্যই পারে দক্ষিণ এশিয়াকে অনিশ্চয়তা থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গণসংযোগ কর্মকর্তা
আমার বার্তা/বিল্লাল বিন কাশেম/এমই