দেশের ব্যাংকিং খাত এখন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। যখন বেসরকারি কিছু দুর্বল ব্যাংক উদ্ধারে ব্যস্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ছে। খেলাপি ঋণের পাহাড়, মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন সংকট আর কমতে থাকা মুনাফায় এসব ব্যাংক আজ টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে।
যদিও চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক দেশের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু আজ তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করছে। আর বিশেষায়িত ব্যাংক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিণত হওয়া বেসিক ব্যাংকের করুণ দশা চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক তথা সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে সেটি আরও ৮ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা কমেছে। চলতি বছরের জুন শেষে চার ব্যাংকের ঋণ স্থিতি নেমে এসেছে ৩ লাখ ৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকায়।
কেবল ঋণ বিতরণে হতাশাজনক চিত্রই নয়, বরং গত ছয় মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকগুলোর অন্য সব আর্থিক সূচকেও অবনতি হয়েছে। জুন শেষে চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ঠেকেছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬১ কোটি টাকায়। বিতরণকৃত ঋণের ৪৮ দশমিক ১০ শতাংশই এখন খেলাপি। আবার খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণেও ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। সোনালী ব্যাংক ছাড়া বাকি তিন ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৩৬ কোটি টাকা।
জানা যায়, আটটি ইনসেনটিভ বা উৎসাহ বোনাসের দাবিতে কয়েক দফায় অবরুদ্ধ করা হয়েছে সোনালী ব্যাংকের এমডিকে। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকে তিনটির বেশি উৎসাহ বোনাস দেওয়ার নিয়ম নেই। বাড়তি উৎসাহ বোনাসের দাবিতে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোয়ও আন্দোলন চলছে।
এই চার ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকেই এখন সুশৃঙ্খল পরিস্থিতি নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর শীর্ষ নির্বাহীরা কার্যকর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেননি। কিছু ক্ষেত্রে এমডির চেয়ে ডিএমডিরা প্রভাবশালী। গত দেড় দশকে এ ব্যাংকগুলো থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ কোটি টাকার বেশি লুণ্ঠন হয়েছে। যেসব কর্মকর্তা ওই সময় লুণ্ঠনের সহযোগী ছিলেন, তাদের অনেকেই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন। এক্ষেত্রে ঘুসের লেনদেনও হয়েছে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকের একজন কর্মীও লুণ্ঠনের সহযোগী হিসেবে চাকরিচ্যুত কিংবা বিচারের মুখোমুখি হননি। ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোর বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বও নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংক হলো সোনালী। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির আমানত স্থিতি ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা (আন্তঃব্যাংক আমানত ছাড়া)। এত বিপুল পরিমাণ আমানত থাকা সত্ত্বেও জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ৮৯ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা (স্টাফ ঋণ বাদ দিয়ে)।
চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) সোনালী ব্যাংক ৩ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। তবে এ মুনাফার বেশিরভাগই এসেছে সরকারি কোষাগার থেকে।
জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার কিছুটা কম। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘চেয়ারম্যান হিসেবে আমি নিজের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। পর্ষদের দায়িত্ব হলো নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখা। গৃহীত নীতির বাস্তবায়নের দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। তবে আমরা ভালো করার চেষ্টা করেছি।’
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঘিরে কোনো সংস্কার উদ্যোগই নেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করে সোনালী ব্যাংক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ ব্যাংকগুলোতে সংগঠিত অনিয়ম-দুর্নীতি উদঘাটন ও ঋণের প্রকৃত মান নির্ণয়ে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) করা যেতো। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো উদ্যোগও আমরা দেখিনি। দেশের বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বিরাজমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না। উদ্যোক্তারা না চাইলে আমরা ঋণ দেব কোথায়।’
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শওকত আলী খান বলেন, ‘কেবল ঋণ স্থিতির দিকে তাকালে মনে হবে আমরা কোনো ঋণ দিচ্ছি না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা বড় ঋণ না দিলেও এসএমই খাতে অনেক ঋণ বিতরণ করেছি। বিরাজমান পরিস্থিতিতে এসএমই খাতেই বেশি ঋণ দেয়া দরকার। ব্যাংকের অন্যান্য আর্থিক সূচকও উন্নতি হচ্ছে।’
জানা যায়, গত দেড় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে জনতা ব্যাংক। বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা, এননটেক্স, ক্রিসেন্টসহ বেশকিছু বড় গ্রুপ ব্যাংকটি থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণ এখন খেলাপির খাতায় উঠেছে। এ কারণে জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ১০৭ কোটি টাকায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর মতো জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও বিশৃঙ্খলা চলছে। নানা পরিষদ ও সংগঠনের নামে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার সময় আমি একটি বিধ্বস্ত ব্যাংক পেয়েছি। সে অবস্থা থেকে ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। নেতিবাচক ভাবমূর্তি সত্ত্বেও ১৬ হাজার কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। বিপুল পরিমাণ এলসি দায় বকেয়া ছিল। সেসব দায় এরই মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা একই শাখা কিংবা বিভাগে তিন বছরের বেশি থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু জনতা ব্যাংকে অনেক কর্মকর্তা একই জায়গায় সাত-আট বছর ধরে বসে ছিলেন। এ ধরনের কর্মকর্তাদের বদলি করেছি। তবে আর্থিক পরিস্থিতির কারণে ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
জনতার মতোই আর্থিকভাবে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি ৭২ হাজার কোটি টাকায় আটকে আছে।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের বিরাজমান সংকট কল্পনারও বাইরে। ২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটিকে একেবারে শেষ করে ফেলা হয়েছে। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দেখলাম, ব্যাংকের নস্ট্র অ্যাকাউন্ট থেকে (বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের উদ্দেশ্যে খোলা হিসাব) প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ডেবিট হয়েছে, কিন্তু গ্রাহকের হিসাব থেকে তা ডেবিট হয়নি। ৭৩৫ দিন ধরে এ পরিমাণ অর্থ ওভারডিউ রাখা হয়েছে। আমার দীর্ঘ ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে এত বড় জালিয়াতির কথা শুনিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত দেড় দশকে অগ্রণী ব্যাংক থেকে কেবল আওয়ামী ঘরানার লোকেরা ঋণ পেয়েছে। জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে অনেক ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এখন সেসব ঋণ আর ফেরত আসছে না। বর্তমানে এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৪০ শতাংশ। অথচ ২০১০ সালে শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে আমি যখন দায়িত্ব শেষ করি তখন অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ হাজার ১০২ কোটি টাকা বা ১০ শতাংশেরও কম। এত ভালো একটি ব্যাংককে পরবর্তী সময়ে শেষ করে দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর নগদ আদায়, পুনঃতফসিলসহ আইন অনুমোদিত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
আর্থিক সব সূচকে নিম্নমুখী অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকও। চলতি বছরের ছয় মাসে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি না বেড়ে উল্টো ১ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২ হাজার ১৭৯ কোটি টাকাই খেলাপির খাতায় উঠেছে।
এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলছেন, ‘তারা ভালো গ্রাহক দেখে ঋণ দিচ্ছেন। এ কারণে ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবও রয়েছে।’
রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে এসএমই ও কৃষি খাতে ৩-৫ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এসব ঋণের বেশির ভাগ প্রস্তাব শাখায় নয়, বরং এমডি দপ্তর থেকেই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রেও নানা ধরনের অনিয়ম হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটিতে যতগুলো পদোন্নতি হয়েছে, তার বেশির ভাগই বিতর্কিত। মেধা কিংবা দক্ষতায় অনেক পিছিয়ে থাকা কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। বিপরীতে যোগ্যরা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়ায় কর্মকর্তাদের চাপের মুখে পড়ে সুপার নিউমারারি (পদ ছাড়াই পদায়ন) হিসেবে প্রায় দেড় হাজার জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।’
কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কাছে বড় বড় গ্রাহক ঋণের জন্য আসছেন। কিন্তু আমি তাদের বলে দিচ্ছি, ঋণ পেতে হলে আগে শাখায় যেতে হবে। শাখা থেকে প্রস্তাব এলে তবেই আমরা ঋণ দিচ্ছি। ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কিংবা পদোন্নতিতে কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই।’
জানা যায়, বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে অর্থ মন্ত্রণালয় বৈঠক ডেকেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারকের সভাপতিত্বে এ সভায় রাষ্ট্রায়ত্ত সবক’টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
তথ্য সুত্র: বণিক বার্তা
আমার বার্তা/এল/এমই