
বিশ্বের দৃষ্টি এখন ব্রাজিলের বেলেমে অঞ্চলে। অ্যামাজনের ওই শহরে আগামী সোমবার (১০ নভেম্বর) থেকে শুরু হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের ৩০তম অধিবেশন (কপ-৩০)। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন, অর্থায়নের ঘাটতি ও কমে যাওয়া বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে সম্মেলনের প্রত্যাশা আগের মতো উচ্ছ্বসিত নয়। বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এবারের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দাবি সামনে রেখে। ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে একটি সরকারি প্রতিনিধিদল বেলেমের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। বাংলাদেশ এবারের সম্মেলনে- জলবায়ু ন্যায়বিচার, অভিযোজন সহায়তা এবং বৈশ্বিক অর্থায়ন—এই তিনটি মূল ইস্যু বিশ্বের সামনে তুলে ধরবে।
অ্যামাজন রেইনফরেস্টের প্রবেশদ্বার বেলেমে অনুষ্ঠিত দুই সপ্তাহব্যাপী এই সম্মেলনে প্রায় ১৫০টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেবেন। সম্মেলনের লক্ষ্য জলবায়ু কর্মপরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ নির্ধারণ করা। কিন্তু কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকদের মতে, সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে কপ-৩০ থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখার মতো বড় কোনও সাফল্য পাওয়া কঠিন হবে।
ন্যায়বিচারের দাবিতে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান
এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশ জলবায়ু ন্যায়বিচার, অভিযোজন সহায়তা এবং বৈশ্বিক অর্থায়ন—এই তিনটি মূল ইস্যু বিশ্বের সামনে তুলে ধরবে। তবে বাংলাদেশের এই প্রতিনিধিদলে নেই প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও সচিব ফারহিনা আহমেদ। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে পাঁচটি অগ্রাধিকারমূলক লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো-
১. ২০৩৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নতুন বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্য নির্ধারণ।
২. ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল (লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড) ২০২৬ সালের মধ্যে চালু করা, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সরাসরি অর্থায়ন পেতে পারে।
৩. অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করা (২০২৫ সালের মধ্যে), বিশেষ করে স্থানীয়ভাবে পরিচালিত, নারী ও তরুণ নেতৃত্বাধীন প্রকল্পে।
৪. ন্যায়সঙ্গত জ্বালানি রূপান্তর নিশ্চিত করা, যেখানে কর্মসংস্থান ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সমান সুযোগ থাকবে।
৫. ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানো।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে আছেন সেন্টার ফর ক্লাইমেট অ্যান্ড অ্যানভায়রনমেন্টাল রিসার্চের (সিসিইইআর) সহকারী পরিচালক রওফা খানম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ইতোমধ্যে বৈশ্বিক নিষ্ক্রিয়তার মূল্য দিচ্ছে। এখন আর কেবল প্রতিশ্রুতির কথা নয়, আমরা চাই জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার।’
বৈশ্বিক জলবায়ু ক্লান্তির যুগে কম প্রত্যাশা
এক দশক আগে বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশ মিলে প্যারিসে যখন জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে সই করেছিল, তখন মনে হয়েছিল, মানবজাতি অবশেষে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায় বুঝতে শিখেছে। কিন্তু ১০ বছর পেরিয়ে আজ সেই গতি স্পষ্টতই মন্থর। ফলে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি, অপূর্ণ অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা আন্তর্জাতিক জলবায়ু কূটনীতিতে আস্থা নষ্ট করেছে।
এ বিষয়ে ইউরোপীয় এক আলোচক বলেন, ‘বিশ্ব এখনও কথাকে কাজে রূপ দিতে পারছে না। কপ-৩০-এর আসল পরীক্ষা হলো, এটি বক্তব্যের বাইরে গিয়ে কার্যকর অঙ্গীকার আনতে পারবে কি-না।’
এই বছরের সম্মেলন এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন জ্বালানি অনিরাপত্তা, মুদ্রাস্ফীতি ও রাজনৈতিক মেরুকরণ বৈশ্বিক ঐক্যকে দুর্বল করে দিয়েছে।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা প্রত্যাশার তুলনায় কম
জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসি) তথ্য অনুযায়ী, আসন্ন জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও এবার অনেক কম। বেলেম সম্মেলনে মাত্র ১২ হাজার ২০০ জন প্রতিনিধি নিবন্ধন করেছেন। যা গত বছরের দুবাইয়ের কপ-২৮-এর তুলনায় প্রায় ৭ গুণ কম। দুবাই সম্মেলনে প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৪ হাজার।
শুরুতে প্রায় ৪৫ হাজার অংশগ্রহণকারী এবারের সম্মেলনে অংশ নেবে বলে আশা করেছিল ব্রাজিল সরকার। তবে পর্যটন অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, হোটেল ঘাটতি ও ব্যয়বহুল যাতায়াত খরচের কারণে অনেক দেশ প্রতিনিধিদল ছোট করে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। বেলেমে শহরটিতে ৫৩ হাজার শয্যা প্রস্তুত রাখা হলেও স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সক্ষমতার সীমা প্রায় ছুঁয়ে গেছে। বেলেমের মেয়র অ্যাদিমিলসন রদ্রিগেস নিজেও তা স্বীকার করেছেন।
তবু ব্রাজিল চায় এই সম্মেলনকে ব্যবহার করে একটাই বার্তা দিতে- ‘অ্যামাজন রেইনফরেস্ট শুধু দক্ষিণ আমেরিকার নয়, এটি পৃথিবীর ফুসফুস।’
অ্যামাজনকে কেন্দ্র করে ব্রাজিলের উদ্যোগ
আয়োজক দেশ হিসেবে ব্রাজিল এবারের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনকে কেবল কূটনৈতিক আয়োজন নয়, বরং একটি প্রতীকী মুহূর্ত হিসেবে তুলে ধরছে— বিশেষ করে উষ্ণমণ্ডলীয় বন সংরক্ষণ ও অ্যামাজন রেইনফরেস্ট রক্ষাকে বৈশ্বিক জলবায়ু নীতির কেন্দ্রে আনার লক্ষ্যে। সম্মেলনের আগে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা ‘ট্রপিক্যাল ফরেস্ট ফরেভার ফ্যাসিলিটি’ নামে একটি আর্থিক কাঠামো ঘোষণা করেছেন। এই উদ্যোগের লক্ষ্য উষ্ণমণ্ডলীয় বন সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অংশ নেওয়া দেশগুলোকে পুরস্কৃত করা।
দেশটির একজন সরকারি কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ব্রাজিল দেখাতে চায়, অ্যামাজন রক্ষা শুধু পরিবেশগত দায়িত্ব নয়, এটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও।’ তবে সমালোচকরা বলছেন, কপ-৩০ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে ব্রাজিল সরকার অ্যামাজন বেসিনে নতুন তেল অনুসন্ধানের অনুমোদন দিয়েছে—যা তাদের জলবায়ু অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অগ্রণী ভূমিকায় আদিবাসী নেতৃত্ব
অ্যামাজনের আদিবাসী সম্প্রদায় এখন কেবল কপ-৩০ সম্মেলনে উপস্থিতই থাকেন তা নয়, বরং তারা নেতৃত্বের ভূমিকায় উঠে এসেছেন। নিজেদের দাবি সরাসরি বিশ্ব নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে অ্যামাজন নদী বেয়ে শতাধিক আদিবাসী নেতা নৌবহর নিয়ে বেলেমে আসছেন। কেউ কেউ সম্মেলনের আশপাশে তাঁবু স্থাপন করছেন, ‘বনের রক্ষক’ হিসেবে নিজেদের প্রতীকী উপস্থিতি জানান দিতে।
কপ-৩০ সম্মেলনে ব্রাজিলের আদিবাসী কর্মী ও মন্ত্রী সোনিয়া গুয়াজাজারা বিশেষ গুরুত্বের ভূমিকা পালন করছেন। তিনি বলেছেন, ‘দশকের পর দশক আমরা এই ভূমি জীবন দিয়ে রক্ষা করেছি। অ্যামাজন ধ্বংস হলে জলবায়ু ব্যবস্থাও ধসে পড়বে।’
ড. আইনুন নিশাতের বিশ্লেষণ
এবারের কপ-৩০ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যামেরিটাস অধ্যাপক ও খ্যাতনামা জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে কপ-৩০-এ তার লক্ষ্যগুলো খুব স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কী চাই—অর্থায়ন, অভিযোজন, না প্রযুক্তি হস্তান্তর। দিকনির্দেশনা না থাকলে আমরা আলোচনার ভিড়ে হারিয়ে যাবো।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘জলবায়ু অর্থায়নে সরাসরি প্রবেশাধিকারই বাংলাদেশের মূল দাবি হওয়া উচিত। অর্থই জলবায়ু ন্যায়বিচারের ভিত্তি। ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে সরাসরি প্রবেশাধিকার না থাকলে এসব প্রতিশ্রুতি প্রতীকী হয়ে থাকবে।’
ড. নিশাত আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্বও তুলে ধরে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া সম্মেলনের বাইরেও একসঙ্গে কাজ করতে পারে—যেমন নদী ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিনিময়, জলবায়ু-সহনশীল কৃষি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে কেবল ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে নয়, বরং উদ্ভাবনী ও সহনশীল জাতি হিসেবে উপস্থাপন করা উচিত। ভাসমান কৃষি থেকে সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র— আমাদের অভিযোজন কৌশলগুলোর বিশ্বব্যাপী মূল্য আছে।’
সম্মেলন নিয়ে তার মন্তব্য, ‘বেলেম থেকে অলৌকিক কিছু আশা করা ঠিক নয়। তবে প্রতিটি কপ ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করে। আমাদের জানতে হবে— কতদূর অগ্রগতি হলো, আর কোথায় লড়াই বাকি রইলো।’
প্রতীক ও সংশয়ের সম্মেলন
কপ-৩০ হয়তো নতুন কোনও বিশাল চুক্তি আনবে না, কিন্তু এটি নির্ধারণ করবে— বিশ্ব কী এখনও একসঙ্গে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সক্ষম, নাকি রাজনৈতিক বিভাজন সেটিকেও গ্রাস করছে।
বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য সংকট কোনও তত্ত্ব নয়, এটি বর্তমান বাস্তবতা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা ইতোমধ্যেই জীবিকা বদলে দিচ্ছে।
ড. নিশাত সতর্ক করে বলেন, ‘যদি কপ-৩০ বাস্তব ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়, এটি শুধু কূটনৈতিক ব্যর্থতা হবে না— এটি হবে মানবতার ব্যর্থতা।’
আমার বার্তা/জেএইচ

