অনৈতিক রিং বাণিজ্য ও অপচিকিৎসার ফলে অকালে ঝরে যাওয়া জাকির হোসেন খান (৫১)-এর অপমৃত্যুর ঘটনায় জড়িত চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে জাকির হোসেন খান-এর পরিবার। সংবাদ সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট দুই চিকিৎসকের চিকিৎসা সনদ বাতিলের দাবি করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জাকির হোসেন খানের স্ত্রী নূরুন নাহার। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাকির হোসেন খানের ভাই গোলজার হোসেন খান, শ্যালক মানিউল্লাহ মানি, বোন-জামাই সাইফুল ইসলাম, বন্ধু মো. টিটুসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা।
নূরুন নাহার বলেন, আমার স্বামী গত ১২ মার্চ আনুমানিক সকাল ৮টায় শারীরিক অসুস্থতা বোধ করলে আমি তাকে গ্রীন লাইফ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাই।
সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান (কনক) ভর্তি হতে বলেন। সে অনুযায়ী ১২২৭/এ কেবিনে ভর্তি হলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগীর চিকিৎসাপত্রে শুধুমাত্র ৩টি গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দেন। পরবর্তীতে একই দিন সন্ধ্যায় বি.আর.বি হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোলজির ডাক্তার মো. মাহবুবুল আলম (প্রিন্স) কে দেখালে উনি রোগীর ডায়াবেটিস ও বুকের ব্যথার বিষয়টি জেনে একজন হার্টের ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেন।
বি.আর.বি হাসপাতালের ডা. শেখর কুমার মণ্ডলকে (ক্লিনিক্যাল ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট) দেখালে তিনি রোগীর ইসিজি ও ইকো করানোর পরে রোগী ঘণ্টা দেড়েক এর বেশি বাঁচবে না বলে রোগীর সামনেই আমাকে জানান। যত দ্রুত সম্ভব রোগীর এনজিওগ্রাম করে হার্টে রিং পরাতে হবে। এ কথা শোনার পর আমার স্বামী ঘাবড়ে যায়।
তিনি বলেন, আমার স্বামীকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে, ডাক্তার তৎক্ষণাত বললেন, আপনার স্বামীর হার্টের কার্যকারিতা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। রোগীর বর্তমান যে অবস্থা, এত সময় আপনারা পাবেন না। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। রোগীকে নিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতালে যেতে চাইলে ডাক্তার বলেন, ল্যাবএইডের ক্যাথল্যাব রেডি নাই। একমাত্র গ্রীন লাইফ হাসপাতালেই ক্যাথল্যাব রেডি আছে। তিনি নিজেই রিং পরাবেন বলে জানান ও ডাক্তার শেখর কুমার আমাদেরকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে গ্রীন লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যান।
আমরা গ্রীন লাইফ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে বসে আমার দেবরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ডা. শেখর কুমার মণ্ডল আমাকে টেলিফোনে ধমকের সুরে বলেন, আপনি এখনো রোগী নিয়ে বসে আছেন ? দ্রুত চলে আসেন। আমি ও অধ্যাপক ডা. গোলাম আজম ওটি রেডি করে বসে আছি। ততক্ষণে আমার দেবরও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন গ্রীন লাইফ হাসপাতালে পৌঁছে রোগীর সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে আমার দেবরকে ডাক্তাররা কোনো ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেনি। রোগীকে কোন প্রকার রিং পরানো হবে, কি ব্র্যান্ড, কত টাকা লাগবে এসব কোনো ধরনের তথ্য প্রদান না করে আমাদেরকে পাশের একটা রুমে অপেক্ষা করতে বলেন।
নূরুন নাহার বলেন, আমার স্বামী মরহুম জাকির হোসেন খান বিগত প্রায় ৭/৮ বছর ধরে ডায়াবেটিসের রোগী। নিয়মিত ইনসুলিন নিতেন। এই বিষয়ে আমরা ডা. শেখরকে বি,আর,বিতে উনার চেম্বারে অবহিত করার পরও তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর অপারেশনের আগে ও পরে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি। গত ১৩ মার্চ বিকেল পৌনে ৪টায় ডাক্তার ডা. শেখর মণ্ডল আমাকে ফোনে বলেন, রোগীর অবস্থা ভালো না, রোগীর কিটোন বডি পজিটিভ।
আমরা রোগীকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে চাইলে ডা. শেখর কুমার মণ্ডল অসম্মতি জানান এবং বলেন আমার উপর বিশ্বাস রাখেন। ১৫/২০ মিনিট পর আইসিইউ ইনচার্জ ডাক্তার মো. আসাদুজ্জামান আমাদের ডেকে বলেন রোগীর ফুসফুসে নিউমোনিয়াসহ মাল্টিপল অর্গান ফেল করেছে। এরপর রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। রোগীর অবস্থা আস্তে আস্তে অবনতির দিকে যেতে থাকে। এরপর গত ১৩ মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় আইসিইউ থেকে রোগীকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।
লাইফ সাপোর্ট দেয়ার আগেই হার্ট ফেইলর হওয়াতে ফুসফুসে রক্ত ও পানি জমে যায়। ক্রমান্বয়ে রোগীর অবস্থা আরও অবনতি হতে থাকে। এক পর্যায়ে রোগী মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি বলেন, ডাক্তার শেখর কুমার মণ্ডল আমাদেরকে কিছু না বলে ঐ রাতে গোপনে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। পরদিন ১৬ মার্চ সকাল ১১টায় লাশ গ্রহণ করতে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনার বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাই। আমাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একাধিকবার সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সাথে আমাদের উপস্থিতিতে মোবাইলে কথা বলেন।
পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও আলাপ-আলোচনা করে এবং সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে তারা নিশ্চিত হন যে, আমাদের মৌখিক অভিযোগের যথেষ্ট সত্যতা রয়েছে। ফলে তারা এই দুর্ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে হাসপাতালের বিল ৬,২৪,৪৪৬/- (ছয় লক্ষ চব্বিশ হাজার চারশত ছেচল্লিশ) টাকা দাবি না করে লাশ নিয়ে যেতে বলেন এবং হাসপাতালের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে বিষয়টি বাহিরে আলাপ-আলোচনা না করতে আমাদের অনুরোধ করেন।
কিন্তু তারা যে বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলো সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেননি। উল্লিখিত বিষয়ে আমরা রাজধানীর কলাবাগান থানায় জিডি করি। ডিজি হেলথও বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে বিচার চেয়ে অভিযোগ জমা দেই। কিন্তু আমি কারো কাছ থেকেই এখনো পর্যন্ত ন্যায় বিচার পাইনি।
আমার স্বামী আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আমার স্বামী ছিলেন আমার আশ্রয়, আমার মেয়েদের আশ্রয়। আমরা এখন অভিভাবকহারা, আমার সন্তানরা এখন এতিম। এরজন্য দায়ী কে? প্রয়োজনীয় চিকিৎসার যন্ত্রপাতি না থাকাসহ সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও অবহেলায় অপচিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন আমার স্বামী। আমি ও আমার পরিবার চাই সংশ্লিষ্ট দুই চিকিৎসকের চিকিৎসা সনদ বাতিল করা হোক।