
সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ঘোষণার পঞ্চম বর্ষপূর্তি পার হলেও সাগর পারের জেলেদের কান্না থামছে না। দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের ১ লাখ ৪০ হাজার জেলেদের মুক্তিপণ আতঙ্ক দূর হচ্ছে না। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। সুন্দরবনকে ঘিরে ৩২টি জল ও বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা মৎস্যজীবীদের জিম্মি করে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাত।
পরবর্তীতে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সাবে র্যাবের মহাপরিচালককে প্রধান সমন্বয়ক করে সুন্দরবন জলদস্যু দমনে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে জলদস্যু মুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। র্যাবের একের পর এক সাঁড়াশি অভিযানে জলদস্যুরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অনেকেই অস্ত্র ও গুলিসহ র্যাবের অভিযানে ধরা পড়ে। আর পালিয়ে থাকা জলদস্যুরা ফেরারী জীবনের অবসান ঘটিয়ে আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়।
তারপরেও মুক্তিপণের দাবিতে কক্সবাজার, মহেশখালী, টেকনাফ, চকরিয়া, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলা এলাকার বঙ্গোপসাগর থেকে জলদস্যুরা প্রায় ১ হাজার মাছ ধরার বোট (মাছ ধরার নৌকা) মাঝিকে অপহরণ করেছে। অধিকাংশই টেকনাফের সাগর মহনা, মহেশখালী মহনা, ভোলার চরফ্যাশন, ঢালচর, চর কুকরিমুকরি, লালমোহনের বুড়া গৌরাঙ্গ, পটুয়াখালীর চরবিশ্বাস, মহিপুর, ফাতরার চর, সোনার চরসহ বিভিন্ন এলাকার বঙ্গোপসাগর ও অন্যান্য নদী মোহনা থেকে অপহরণ অব্যাহত রয়েছে বলে জেলেরা জানান।
জলদস্যুরা ১ থেকে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে বলে মাঝিরা জানান। জলদস্যুদের নির্ধারিত মুক্তিপণের টাকা দিতে অস্বীকার করলে তাদের খুন করা হয়। মাছ ধরার ট্রলার মালিকরা বলেছেন, জলদস্যুদের মুক্তিপণের টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ১ বছরে ১৭ জন মাঝিসহ জেলেদের জলদস্যুদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে।
দস্যুমুক্ত ঘোষণার প্রায় পাঁচ বছর পর সুন্দরবনের মিরগামারী খাল থেকে অস্ত্রসহ তিন বনদস্যুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে নৌকা ও ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন মালামাল জব্দ করা হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর ভোরে বনের গহিনে শেলা নদীর বাওন থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। দুপুরে আদালতের মাধ্যমে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার বনদস্যুরা হলেন: শরণখোলা উপজেলার বাসিন্দা মাসুম ফরাজী (৩৫), হাছান কবিরাজ (৩০) ও বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার আলমগীর হোসেন হাওলাদার (৫০)। পুলিশ জানায়, ২০১৮ সালে সরকার সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ঘোষণা করার পর থেকে বনের অভ্যন্তরে জেলে ও বাওয়ালিরা শান্তিতে বনের বনজসম্পদ আহরণ করে আসছিলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর হঠাৎ নতুন একদল বনদস্যুর আবির্ভাব হয়। গত বছর ৯ ডিসেম্বর রাতে ওই দস্যুরা জেলেবহরে হামলা ও লুটপাট চালায় এবং ১৫ জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণের দাবি করে। পরে ২১ ডিসেম্বর সকালে জেলেরা ১০ হাজার টাকা করে মুক্তিপণ দিয়ে তাদের জিম্মিদশা থেকে ফিরে আসেন।
এদিকে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাগেরহাটের রামপাল ডিগ্রি কলেজ মাঠে র্যাব আয়োজিত সুন্দরবন দস্যুমুক্ত দিবসের তৃতীয় বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিনে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিক নির্দেশনায় সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করতে পেরেছি। সুন্দরবন অঞ্চলে আর দস্যুবৃত্তি করতে দেয়া হবে না।
মন্ত্রী আরও বলেছিলেন, এক সময় সুন্দরবনের জেলে বাওয়ালী ও মৌয়ালরা বনদস্যুদের হাতে জিম্মি এবং প্রায়ই বনদস্যুদের হাতে তাদের জীবন হারাতে হতো। দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে এখন শান্তির সুবাতাস বইছে।
এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের ১০২টি ঘর, ৯০টি মুদি দোকান (মালামালসহ), ১২টি জাল ও মাছ ধরার নৌকা, ৮টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা এবং গবাদিপশু হস্তান্তর করেন। র্যাবের অভিযানে ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যুবাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে। তাদের কাছ থেকে ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
আত্মসমর্পণের পর তাদের পুনর্বাসনে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা এবং র্যাবের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তাসহ সামাজিক নিরাপত্তা দেয়া হয়। এর মাধ্যমে দস্যুরা ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে।
র্যাবের দাবি, সুন্দরবনে বর্তমানে শান্তির সু-বাতাস বইছে। অপহরণ-হত্যা এখন নেই। জেলেদের কষ্টার্জিত উপার্জনের ভাগও কাউকে দিতে হচ্ছে না। মাওয়ালী, বাওয়ালী, বনজীবী, বন্যপ্রাণী এখন সবই নিরাপদ। নির্ভয়ে-নির্বিঘ্নে আসছে দর্শনার্থী, পর্যবেক্ষক, জাহাজ বণিকরা। এভাবেই সরকারের দূরদর্শিতায় সুন্দরবন কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক গতিশীলতা ব্যাপক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলো।
এদিকে পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার ১ লাখ ৪০ হাজার জেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ছোট-বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো রয়েছেই, এর সঙ্গে দিন দিন বেড়ে চলেছে জলদস্যুর উপদ্রব। এদের মধ্যে অনেককেই প্রথমে অপহরণ করে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। তারা আর কোনদিন ফিরে আসেননি স্বজনদের কাছে। আর গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে এ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে কতজন জেলে নিখোঁজ হয়েছেন তার কোন হিসাব জানা নেই কারো।
পটুয়াখালী জেলা থেকে ৭৫ কিলোমিটার পশ্চিমে খেপুপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নে বাংলাদেশ শেষ সীমানার রাবনাবাদ নদী বঙ্গোপসাগর মোহনা পাড়ের মুক্তিপণ আতঙ্কে দিশেহারা আক্কাস মাঝি, মোস্তফা গাজী, নজির হাওলাদার, মোশাররফ হোসেন ও আনিস মাঝি।
মাঝিরা জানান, সম্প্রতি সমুদ্রে একটি শিপিং বোটে হানা দিয়ে জলদস্যুরা আবু তাহের মাঝিসহ ১৭ জেলেকে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেয়। বোটটি শহরের উত্তর নুনিয়াছড়ার হক কোম্পানির ফিশিং বোর্ড বলে জানান তারা। এ বিষয়ে মির্জাগঞ্জের মৎস্য নেতা মো. ইউনুস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মাঝিদের মৃত্যুর খবর কেউ জানেও না।
কেউ দেখতেও আসে না। ভোটের সময় নির্বাচনে প্রার্থীরা কয়েকবার এসে তাদের ক্ষতিপূরণ এবং নিরাপত্তা দেয়ার কথা বললেও নির্বাচনের পর কোন প্রার্থীরই খবর থাকে না বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, উপকূলের মাঝি-মাল্লারা জীবন দিচ্ছে ছোট-বড় প্রাকৃতিক ঝড়েও। এমন অনেক মাঝি ঝড়ে নিখোঁজ হয়েছেন, যাদের খবরও কেউ জানে না। তবে গত কয়েক বছরে এ অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আমার বার্তা/ওসমান

