বাংলাদেশ রেল এবার আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু করতে যাচ্ছে। আজ বুধবার (১ নভেম্বর) যাত্রী নিয়ে বাংলাদেশে রেলের গাড়ি ছুটে যাবে ঢাকা থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা অবধি।
আজ ১ নভেম্বর ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক ট্রেন রুট উদ্বোধন করবেন বলে রেলওয়ের সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
একই দিনে কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুর ভাঙ্গা হয়ে খুলনা ও যশোর বেনাপোলে যাবে যাত্রীবাহী ট্রেন ও খুলনা থেকে নতুন পথে ট্রেন ছুটবে মোংলা পর্যন্ত এমনটিই বলছে রেলবিভাগ। যা দেশের রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত একই সঙ্গে কাক্সিক্ষত এই রেল পরিষেবা আজ বুধবার শুরু হবে বলে নিশ্চিত করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, সারাদেশে রেলওয়ের মোট দুই হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার রুট রয়েছে। নভেম্বরে তা বেড়ে তিন হাজার ২১৭ কিলোমিটারে উন্নীত করার সব কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এ জন্য রেল ৪টি মেগা প্রকল্প হাতে নেয়। যার কাজ শেষান্তে একই সঙ্গে দেশীয় ও আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১ নভেম্বর চালু হচ্ছে উল্লেখিত তিন মেগা প্রকল্প। প্রকল্প ৪টি হলো-পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ও আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, চারটি প্রকল্পের মধ্যে পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেলপথ গত ১০ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ, খুলনা থেকে মোংলা সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ ও বাংলাদেশের আখাউড়া থেকে ভারতের আগরতলা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।
এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে। তিনি যেমনটি বলছিলেন। দেশের প্রতিটি জেলায় রেললাইন সম্প্রসারণে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে আজ বুধবার পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্পসহ তিনটি প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে। মন্ত্রী বলেন, দেশের রেললাইন ইলেকট্রনিক ট্রেকে রূপান্তরিত করা হবে। সিঙ্গেল লাইনগুলো ধীরে ধীরে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হচ্ছে এবং হবে। তাই আজ আখাউড়া থেকে আগরতলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্প এবং খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে বলে জানান মন্ত্রী।
আখাউড়া-আগরতলা রেলপথের উদ্বোধন:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলপথে ট্রেনের চূড়ান্ত ট্রায়াল রান হয়েছে। গত সোমবার (৩০ অক্টোবর) ১২টা ২০ মিনিটে খালি বগি নিয়ে ট্রেনটি ভারতের নিশ্চিন্তপুরে যাত্রা করে। এ উপলক্ষে গঙ্গাসাগর রেলস্টেশনে কাস্টমস ও কার্যক্রম শুরু হয়। ট্রেনের পরিচালক, সহকারী পরিচালক, চালকসহ ৭ জন সেখানে তাদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ট্রেনটি নিয়ে ভারতের নিশ্চিন্তপুর যান এবং ফিরে আসেন।
এ বিষয়ে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথের প্রকল্প পরিচালক মো. আবু জাফর মিয়া জানান, আজ ১ নভেম্বর ভার্চুয়ালি বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। প্রথম দিকে পণ্যবাহী ট্রেন এবং পরবর্তীতে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করবে দু’দেশের মধ্যে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে আখাউড়ার গঙ্গাসাগর থেকে আগরতলার নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশ রয়েছে ৬.৭৮ কিলোমিটার। করোনা মহামারিসহ নানা সংকটের কারণে দেড় বছর মেয়াদি প্রকল্পের কাজ শেষ করতে সময় লাগছে পাঁচ বছরেরও বেশি।
খুলনা থেকে নতুন পথে ট্রেন ছুটলো মোংলায়:
উদ্বোধনের আগে খুলনা মোংলা রেলপথে সফলভাবে সম্পন্ন হলো পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল। গত সোমবার (৩০ অক্টোবর) বিকেলে খুলনার ফুলতলা থেকে কোনো ত্রুটি ছাড়াই সফলভাবে মোংলা পর্যন্ত চারটি কোচসহ ইঞ্জিন নিয়ে পৌঁছায় ট্রেন। এবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষা। আজ ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভার্চুয়ালি এই প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ করতে ২০১০ সালে খুলনার ফুলতলা রেলস্টেশন থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর একনেকে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি।
ভারত সরকারের ঋণ সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টার্বো ও ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কয়েক ধাপে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়। সর্বশেষ প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রূপসা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ। ৫.১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে রেলসেতুর কাজ পুরোপুরি শেষ। ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার পথ হলেও স্টেশনগুলোর ডাবল লাইন হিসাব করে এই প্রকল্পে রেলপথ বসবে ৯১ কিলোমিটার। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৮১ কিলোমিটার রেলপথ বসানো সম্পন্ন হয়েছে। ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত মোট ৯টি প্লাটফর্ম রাখা হয়েছে। সবগুলোর নির্মাণও সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া শেষ হয়েছে ১০৭টি ছোট ব্রিজ ও ৯টি আন্ডারপাস নির্মাণকাজও।
খুলনা-মোংলা রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান জানান, খুলনা-মোংলা রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এই রেলপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার। এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।
বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (পাকশী) শাহ সুফি নুর মোহাম্মদ জানান, খুলনা-মোংলা রেল চলাচলের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ১ নভেম্বর সকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভার্চুয়ালি আনুষ্ঠানিকভাবে এই রেললাইনে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করবেন।
পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্প:
অবশেষে স্বপ্নের পদ্মাসেতু দিয়ে রেল চলবে আজ ১ নভেম্বর থেকে। ইতোমধ্যে ভাড়া কমিয়ে ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু করেছেন রেল কর্তৃপক্ষ। ১ নভেম্বর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও ২ নভেম্বর থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেস নতুন রুট (খুলনা-পোড়াদহ-কুষ্টিয়া কোর্ট-রাজবাড়ি-ফরিদপুর-পদ্মাসেতু-ঢাকা-কমলাপুর) দিয়ে যাতায়াত করবে। এই দুটো ট্রেন আগে কমলাপুর স্টেশন থেকে জয়দেবপুর, যমুনা সেতু হয়ে খুলনা ও বেনাপোলে যেত। এখন আজ ১ নভেম্বর কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুর ভাঙ্গা হয়ে খুলনা ও যশোর বেনাপোলে যাবে বলে রেল কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়।
আন্তঃনগর এই ট্রেনে যাত্রীদের সুষ্ঠু চলাচলের জন্য গত ২৮ অক্টোবর রাত ১০টা থেকে ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার। তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবর থেকে টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। ভাড়া কমানোর পর যেটি ধরা হয়েছে সেই ভাড়াতেই টিকিট বিক্রি হচ্ছে। চেয়ারের ভাড়া ২৩৫ টাকা করে নেয়া হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে লোকাল, মেইল, কমিউটার ও আন্তঃনগর এই চার ধরনের ট্রেন চলাচল করে। লোকাল ট্রেনের ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ৩৯ পয়সা আর আন্তঃনগর ট্রেনের ভাড়া নন-এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ১৭ পয়সা। আর কিলোমিটার প্রতি এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ৯৫ পয়সা। বর্তমানে দেশে লোকাল, মেইল, কমিউটার ও আন্তঃনগর এই চার ধরনের ট্রেন চলাচল করে। লোকাল ট্রেনের ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ৩৯ পয়সা আর আন্তঃনগর ট্রেনের ভাড়া নন-এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া এক টাকা ১৭ পয়সা। আর কিলোমিটার প্রতি এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া এক টাকা ৯৫ পয়সা।
এ বিষয়ে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে পরিচালক মো. আফজাল হোসেন জানান, ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ। তবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৯৭.৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখনো শুধু কিছু স্টেশন ও সিগনালিংয়ের কাজ বাকি আছে। তাই আগামীকাল ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হবে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণসহ পদ্মা সেতু রেল সংযোগের পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালে জুনের মধ্যে শেষ হবে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত তিনটি অংশে রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার মেইন লাইন, ঢাকা-গেন্ডারিয়া পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার ডাবল লাইন, লুপ, সাইডিং ও ওয়াই-কানেকশসসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিপিপি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বৃদ্ধি করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ২০২৪ সালে জুনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন দেয় একনেক সভা। জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পের অর্থায়নে করছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ সহায়তা দেবে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বাকি ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ টাকা ব্যয় হবে সরকারি ফান্ড থেকে।
২০১৮ সালের এপ্রিলে চীনের সঙ্গে চূড়ান্ত ঋণ চুক্তি হয়। এর দুই বছর আগে কমার্শিয়াল চুক্তি হয়েছিল। প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি।
আমার বার্তা/জেএইচ