নতুন করে আরো এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে অধিদপ্তরকে পৈত্রিক সম্পত্তিতে পরিণত করার চক্রান্ত এঁটেছেন যুব উন্নয়নের ডিজি মো. আজহারুল ইসলাম খান। তিনি দু’বছর দায়িত্ব পালন করেও নতুন করে নিয়োগ পেতে পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। তার এই অপতৎপরতার সংবাদ পেয়ে অধিদপ্তরের সৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভিত্তি দানা বাধতে শুরু করেছে।
কারণ, বিগত এক টার্মে এই ডিজি সকল ন্যায়নীতিকে উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছেমতো যুব উন্নয়ন দপ্তর চালিয়েছেন। ফলে যোগ্যরা যেমন বঞ্চিত হয়েছেন তেমনি অযোগ্যরা বড় বড় পদে বসে ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা পেয়েছেন এসব অদক্ষদের কারণে সরকারের সম্ভবনাময় অধিদপ্তরটি অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে।
চলতি বছরের নভেম্বরে তার প্রথম দফার চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তারপরেও তিনি নতুন করে আরও একবছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। তার তদবিরকারীদের ভিতরে রয়েছেন অধিদপ্তরের বেশকিছু সুবিধাবাদী কর্মকর্তা।
এই তদবিরের জন্য তিনি বড় অংকের বাজেট নিয়ে মাঠে নেমেছেন বলে একটি বি সূত্র বলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যেকোনো উপায়ে তিনি নতুন নিয়োগ নিশ্চিত করতে চান। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রথম শর্ত হিসেবে তিনি ইতোমধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে ডিও লেটার নিয়েছেন এবং জনপ্রশাসন প্রতিন্ত্রীর কাছে প্রতিনিয়িত ধর্না দিচ্ছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ‘হয় মন্ত্রের সাধন না হয় শরীর পতনে’র মানসিকতা নিয়েই তিনি মাঠে নেমেছেন। এমনকি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ বাড়াতে লবিস্টও নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। নিজে একজন করিৎকর্মা অফিসার হিসেবে নিয়মিত চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বিশেষ তদবিরের মাধ্যমে প্রথমে ২ বছর এর জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাগিয়ে নেন।
এদিকে ডিজির নিয়োগ নিশ্চিত হলেই স্বপদে ফিরতে পারবেন পাবনার মফিজ রাজাকারের ছেলে ডিডি মোখলেছুর রহমান । অতীতে এই দুজনে মিলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরটি তাদের পৈত্রিক সম্পতিতে পরিণত করেছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রশাসনের নিয়মকে লংঘন করে ১১২ জনের চলতি দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনার নামে ৪০ জন জামায়াত, বিএনপি মতাদর্শে বিশ্বাসী কর্মকর্তাকে চলতি দায়িত্ব দিয়েছেন। চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাতিজা আসাদকে। এছাড়া তারই হাতে ধরে লুণ্ঠিত হয়েছে ন্যাশনাল সার্ভিসের অন্তত ২৫ কোটি টাকা। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। অর্থের অভাবে জনবল নিয়োগও অসম্পূর্ণ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত দুই বছর আকুণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। অযোগ্যদের দাপটে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে সরকারের সম্ভাবনাময় অধিদপ্তরটি। দেশের যুবশক্তিতে উন্নয়নের চালিকা শক্তিতে রূপান্তর ঘটাতে সরকার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর গঠন করে। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লালসার শিকার হয়ে সেটি এখন ডুবতে বসেছে।
অধিদপ্তরের কাজে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ১১৮টি উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার শূন্য পদে নিয়োগের সুপারিশ করে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। চলতি বছরের গত ৯মে এই সুপারিশ প্রস্তাবনা আকারে পাঠানো হয়। কিন্তু এই পদোন্নতির কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হন। নিয়মানুযায়ী ১১৮ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, গত ২৩ আগস্ট মাত্র ৬১ জনকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। ফলে বঞ্চিত হলো ৫৭ জন কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে ৫৭ জন চলতি দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তারা চলতি দায়িত্বরত আছেন। এ কারণে ৫৭ কর্মকর্তার ৫৭টি পদ দখলে আছেন। বর্তমান যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিউদ্দিন আহম্মেদ পুরো ১১৮ জনকে পদোন্নতি দিতে চাইলেও এক্ষেত্রে বাধ সাধে ৭০৩ নং ক্রমিকধারী জসিম ও তাদের গডফাদার সাবেক উপ-পরিচালক প্রশাসন মোখলেছুর রহমান এবং বর্তমান মহাপরিচালক আজহারুল ইসলাম খান। এই অসাধু চক্রটি প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের ক্ষমতা ব্যবহার করে এই অনৈতিক কাজটি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর মহাপরিচালক ১১২ জন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পদে চলতি দায়িত্ব প্রদান করেন। অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে
সিনিয়র ক্রমধারী ৭০৩, ১০৫৮, ৯৮৪, ১১১০--- ৭০ জন জুনিয়র কর্মকর্তাকে চলতি দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এখানে দেখা যায় সরকারের প্রচলিত বিধি বিধান উপেক্ষা, জ্যেষ্ঠতা লংঘন এবং সচিবের নির্দেশনাও উপেক্ষিত হয়েছে। ১৯৯২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত জনপ্রশাসন হতে এবং গত ১৮ এপ্রিলের প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকার সব সময় চলতি দায়িত্ব প্রদানকে নিরুৎসাহিত করে থাকেন।
জ্যেষ্ঠতার তালিকা চূড়ান্ত না থাকলে অন্তত একটি খসড়া জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রণয়ন করে তদানুয়ায়ী চলতি দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। এই দায়িত্ব ২ মাসের বেশি অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই পদোন্নতি কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। ৬ মাসের বেশি অতিক্রান্ত হওয়ার উপক্রম হলেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।
এদিকে পদোন্নতি বঞ্চিতদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১, ১১২ জনের চলতি দায়িত্বটি অবৈধ ঘোষণা করেন। যা গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত বলবত ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে যুব কর্তৃপক্ষ চলতি দায়িত্বটি বাতিলের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। বরং ২ এপ্রিল এক আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতের আদেশটি শুনানি পর্যন্ত স্থগিত করেছেন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্তৃপক্ষ বলছেন, কোর্ট যেহেতু স্থগিতাদেশ দিয়েছে সেহেতু এই পদে এখন আর পদোন্নতির দেয়া যাবেনা বা চলতি দায়িত্ব বাতিল করা যাবে না।
অথচ চলতি দায়িত্বাদেশটি ৯ মাস অবৈধ ঘোষিত ছিল, কর্তৃপক্ষ চাইলেই চলতি দায়িত্ব বাতিল করতে পারতো, কিংবা এখনো পারে কেননা চলতি দায়িত্বাদেশনামায় বলা আছে কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময় আদেশটি বাতিলের ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। তাছাড়া বিধিতে বলা আছে চলতি দায়িত্ব একটি সাময়িক ব্যবস্থা যা পদোন্নতি কার্যক্রমের সাথে সাথেই বাতিল হয়ে যাবে।
জানা গেছে, এত কিছুর পরও বাতিল হচ্ছে না চলতি দায়িত্বাদেশটি। ফলে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। এই অশান্তির মুল কারিগর হলো মহাপরিচালক আজাহারুল ইসলাম খান, যার সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করছেন মোখলেছুর রহমান যিনি এই চলতি দায়িত্বাদেশ জারিতে জুনিয়র জসিম গংদের কাছ থেকে নিয়েছেন বিপুল অনৈতিক সুবিধা। জানা গেছে, মোখলেছুর রহমান যত জায়গায় চাকরি করেছেন প্রায় প্রত্যেক যায়গায় দুর্নীতির ছাপ রেখে এসেছেন।
মহাপরিচালকের অনেক অনৈতিক কাজের হাতিয়ার হলেন তার বন্ধু উপ-পরিচালক ( অব.) উপ-পরিচালক। এ বিষয়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আজাহারুল ইসলাম খানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেন না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অফিস সহকারী জানান, এ বিষয়ে আমাদের স্যার (ডিজি) কোনো কথা বলবেন না। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে বলে অফিস সহকারী এড়িয়ে যান।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক (প্রশাসন) বর্তমানে নরসিংদী জেলা উপপরিচালক মোখলেছুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর মেলেনি। তবে তিনি বলেছেন, অভিযোগ সঠিক নয়। একটি চক্র অশুভ কাজগুলো করছেন। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ বিষয়ে তিনি বলেন, এটা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বিষয়। এটাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে বলে মোখলেছুর রহমান জানান। তিনি এই প্রতিবেদককে খোঁজ নিয়ে নিউজ করতে বলেন। এছাড়া তিনি এখন হেড অফিসে নাই বলে এর বাইরে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নাই।
মোখলেছুর রহমানের বক্তব্যকে বিরোধিতা করে কয়েকজন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যুব দপ্তরের সকল কর্মচারীর প্রত্যাশা ঐ চিহ্নিত অপরাধী মোখলেছ এবং স্বয়ং মহাপরিচালকে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানান।
তারা বলেছেন, অবিলম্বে চলতি দায়িত্ব বাতিল করে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি প্রদান এবং মোখলেছুরকে আইনের আওতায় এনে অপরাধের এবং অপরাধীর বিচার হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তোভোগী সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাগণ জানায়।এ বিষয়ে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে মুঠোফোনে দুই দফায় যোগাযোগ করা হলে তিনিও এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেন নাই।
এবি/ওসমান