এবার ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া। এখন বাজারে সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও নাগালে আসেনি দাম। ফলে বেশির ভাগ মানুষের পাতে এখনো ইলিশ ওঠেনি। এক কেজি ছোট আকারের ইলিশ এখনো ৬০০ টাকার নিচে মিলছে না।
বাজারে গেলে ইলিশের চড়া দাম নিয়ে ক্রেতাদের ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা যায়। গতকাল সোমবার সকালে কারওয়ান বাজারে এক ক্রেতা বলেন, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া মাছের কেন এত দাম হবে? এ মাছে চাষের খরচ নেই। নেই ফিড বা মেডিসিন খরচ। তারপরও নদী বা সমুদ্র থেকে জাল টেনে ধরে আনা ইলিশের দাম মাংস থেকেও অনেক বেশি।
তিনি বলেন, বাচ্চাদের আগ্রহে এর আগে একদিন ইলিশ কিনেছি। আজ এক কেজি আকারের একটি ইলিশ দেড় হাজার টাকা চায়। গত বছর হাজারের মধ্যে ইলিশ খেয়েছি। এবার আর খাওয়া যাচ্ছে না।
গতকাল সোমবার ঢাকার কারওয়ান বাজার, রামপুরা এবং মধ্য বাড্ডা বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত একমাসের ব্যবধানে ইলিশের দাম কিছুটা কম। তবে ভরা মৌসুম বিবেচনায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এখনো বেশি। এক-দেড় কেজি আকারের ইলিশ এখন ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা অন্য বছরের এ সময় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে থাকতো।
রামপুরা বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম এখন ১৫০০ টাকা, দেড় কেজি ২০০০ থেকে ২২০০ টাকা। ছোট ইলিশের মধ্যে ৮০০ গ্রামের ইলিশের দাম ১৪০০ টাকা, ৭০০ গ্রাম ১২০০ এবং ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
তবে একই আকারের নদীর ইলিশের দাম কিছুটা বেশি। বাড্ডা বাজারে দেড় কেজি ওজনের বড় ইলিশ ৩০০০ হাজার টাকা দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতা। পাশে একই আকারের আরও কিছু ইলিশ রয়েছে, যেগুলো সাগরের বলে দাম ৫০০ টাকা কম বলছেন তিনি। খালেক বলেন, নদীর সঙ্গে সাগরের মাছের স্বাদের পার্থক্য রয়েছে, দামেও তেমন। ভালো খেতে হলে বেশি দাম গুনতেই হবে।
ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম কেন কমছে না এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় জেলে, পাইকার, ঢাকার আড়তদার ও মৎস্যবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তাদেরও ভাষ্য, এ বছর সাগরে ইলিশের দেখা মিললেও নদ-নদীতে এখন খুব মিলছে না ইলিশ। নদীর ইলিশ সুস্বাদু হওয়ায় ভোক্তাদের কাছে এ ইলিশের চাহিদা বেশি।
চাহিদার কারণে অনেকে সাগরের ইলিশ নদীর বলে চড়া দাম হাঁকছেন। নদীর ইলিশ চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় এখনো আকার ভেদে দেড় হাজারের নিচে খুচরা বাজারে ইলিশ মিলছে না। তাই বাজারে সাগরের যে ইলিশ মিলছে তার দামও অপেক্ষাকৃত বেশি।
আবার ব্যবসায়ীরা এ-ও বলছেন, কয়েক বছরের ব্যবধানে জ্বালানি তেল ও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ইলিশের দামে।
সাগরে মাছ ধরেন এমন একজন জেলে ইয়াকুব মিয়া বলেন, একটি মাছ ধরার ট্রলারে জ্বালানি তেল লাগে ১২ ব্যারেল, মবিল লাগে। এ বাবদ খরচ প্রায় ৪০ হাজার টাকা বেড়েছে। আবার বরফ লাগছে ৬৫ হাজার টাকার, যা গত বছর ছিল ৪৫ হাজার। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় জেলেদের অন্তত ১০ দিনের বাজার খরচ দেড় লাখ টাকার মতো। আবার তাদের পারিশ্রমিকও দিতে হচ্ছে বেশি।
তিনি বলেন, এছাড়া ঘাটের ইজারা, মাছঘাটের শ্রমিকের মজুরি, পাইকার, আড়তদারের কমিশনসহ অনেকগুলো খাতে টাকা যায়। খরচ ওঠাতে হলে একটি ট্রলারকে অন্তত ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করতে হয়। তারপরও যারা দাদনে টাকা নেন, তাদের লাভ কম হয়।
এদিকে সাগরের উপকূলেও যারা মাছ ধরেন এমন কয়েকজন জেলে জানিয়েছেন, আগে সব মিলিয়ে তাদের মাছ ধরার খরচ হতো ৭৫ থেকে ৮৫ হাজার টাকার মতো। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে দেড় লাখ টাকা।
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, এখন প্রতিটি ট্রলার (জাহাজ) সাগরে পাঠাতে তাদের ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। ফলে মাছের দাম বাড়িয়ে তাদের ব্যয় সমন্বয় করতে হয়। এতে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষকে বেশি দামে মাছ কিনে খেতে হয়।
সরকার সমুদ্র অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দেয়ার কথা বললেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়ায় এ খাত এখন হুমকির মুখে। ইলিশ মাছের জোগান একদিকে কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে আহরণ ব্যয় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
এদিকে ঢাকার মৎস্য আড়ত মালিকদের সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, আগে নদ-নদীতে প্রচুর ইলিশ মিলত। এসব ইলিশ স্থানীয় বাজারে প্রান্তিক জেলেরা সরাসরি বিক্রি করতেন। এখন প্রান্তিক আড়তে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। কম দামে মাছ পাওয়া যায় না। আবার ঢাকায়ও বাজারজাত খরচ ধাপে ধাপে বেড়েছে।
তিনি বলেন, বরফের দাম-ই দ্বিগুণ হয়েছে গত তিন বছরে। আড়তে শ্রমিকরা কম খরচে কাজ করেন না। বাজারের ইজারা, ভাড়া এসব বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান মৎস্য গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইলিশের দাম কমার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। সবকিছুর দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে এটার প্রভাব ইলিশে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনার কারণে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন বেড়ে যায়। কিন্তু ইলিশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এখন আর দেশে সে ধরনের প্রকল্প ও কার্যক্রম নেই। ডুবোচর, দূষণ ও নিষিদ্ধ জালে ঘিরে রাখায় ইলিশ আর নদীতে ঢুকতে ও টিকতে পারছে না। সে কারণে নদীর ইলিশ ক্রমেই কমছে। এবার সেটা একটি বড় সমস্যা।
যদিও দেশের মৎস্যখাতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে ইলিশ। উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ। তাদের নিরলস পরিশ্রমে ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ। জাটকা নিধন বন্ধ, নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযানসহ সরকারের নানামুখী কঠোর ব্যবস্থাপনায় গত এক যুগে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন লাখ টন।
যার প্রভাব পড়ার কথা এখন ভরা মৌসুমে। ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসার কথা। কিন্তু কোনো কোনো জেলায় ভরা মৌসুমেও আশানুরূপ ইলিশ মিলছে না। সুস্বাদু এ মাছের উৎপাদন নির্ভর করে বৃষ্টিপাত, পানির অবস্থা, প্রবাহ, তাপমাত্রা, এমনকি পূর্ণিমা ও অমাবস্যার ওপর। এসব উপাদানের ছন্দপতন ঘটলেই বিপত্তি।
মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, দেরিতে ইলিশ পাওয়ার বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টির সময়ও পরিবর্তন হয়েছে।
সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়ায়, উপকূলীয় নদ-নদীর পানির লবণাক্ততা কমছে না। ফলে লবণাক্ততা না কমায় দেরিতে প্রবেশ করছে মা-ইলিশ। যেখানে ইলিশ মূলত ডিম ছাড়ার জন্য মোহনা থেকে মিঠা পানির নদ-নদীতে প্রবেশ করে। এছাড়া বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে নদীতে জোয়ারের পানি বাড়তে থাকে। পানি যত বাড়ে নদীতে ইলিশের আধিক্যও দেখা যায়।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, জুলাই মাস ইলিশের মূল মৌসুম নয়, মূলত মৌসুম সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। তবে আগস্ট থেকেই সেটি শুরু হয়। কখনো বৃষ্টি আগে হওয়ার কারণে কিছুটা ব্যতিক্রম হতে পারে। আগস্টে কিন্তু কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে। সেখানে ২ আগস্ট একটি পূর্ণিমা গেছে এবং ১৬ তারিখ একটি অমাবস্যা গেছে।
এর আগে বা পরে কাছাকাছি সময়ে খুব ভালো পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছে। আগস্টে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, সেই অবস্থা সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে। তবে এটি কোনো কোনো সময় নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে যায়। আবার কোনো কোনো সময় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই শীত পড়া শুরু হয়। ফলে নদী শান্ত হয়; ইলিশের দেখা মেলে না।
তিনি বলেন, সর্বশেষ যে প্রজনন সময়টা গেছে তখন রেকর্ড পরিমাণ ৫২ শতাংশ মা-ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছিল। ফলে ৪০ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ইলিশ এবার আগস্ট থেকে পাওয়া গেলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের পরও নভেম্বরের প্রথমদিকে ভালোভাবেই পাওয়া যাবে। এছাড়া নভেম্বরের মাঝামাঝি একটা অমাবস্যা আছে, তখন কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে।
এবি/ওজি