বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে পছন্দের বাহন বাস। আরামদায়ক ট্রেন সার্ভিসকে তারা অনায়াসে উপেক্ষা করতে পারে। কারণ রয়েছে বহুবিধ। দেশের সব জেলা বা উপজেলায় সরাসরি কোন ট্রেন যোগাযোগ নেই।
আবার ট্রেনের টাইমটেবিল নিয়ে রয়েছে এন্তার অভিযাগ।ন’টার ট্রেন কটায় যায় এমন প্রবাদ এখনও কান পাতলেই ভেসে আসে। তাই অনেকেই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা না করে সরাসরি বাসে চলাচল করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আর তারই সুযোগ নিচ্ছে দেশের গণপরিবহণ গুলো।
বিআরটিএর ভাড়ার তালিকাকে উপেক্ষা করে এরা নিজেদের মতো করো ভাড়ায় আদায় করে থাকে। এমনকি ভাড়ার চার্টে তাদের সমিতির সভাপতি- সম্পাদকের স্বাক্ষর দেখা যায়। অথচ গণপরিবহন মালিক সমিতির কোন এক্তিয়ার নেই ভাড়া নির্ধারণের। তবে সব সম্ভবের দেশে এটি হরহামেশা ঘটলেও প্রশাসনিকভাবে এদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার সংবাদ মেলেনা।
উল্টো ওরা যেভাবে ভাড়ার তালিকা প্রণয়ন করে সেভাবেই সাধারণ যাত্রীকে ভাড়া মিটিয়ে চলাচল করতে হয়। আবার বিভিন্ন যায়গায় নিয়িমিত স্টপেজ থাকলেও এমনকি গাড়ির গন্তব্যে তা লিপিবদ্ধ থাকলেও ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে সেটি মানা হয় না। তাই যাত্রীর কাছ থেকে শেষ স্টপেজ পর্যন্ত ভাড়া রাখা হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে পরিবহন শ্রমিক- মালিকরা সর্বশক্তি নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
জানা গেছে, রাজধানী থেকে সারা দেশের ৪৩২টি আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে বাস চলাচল করে। এসব বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। রুটভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) দেওয়া দূরত্ব, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও সওজ’র আওতাধীন ব্রিজ, টোল ও ফেরির ভাড়ার তালিকা অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু এই ভাড়া নির্ধারণ করা থাকলেও তা মানেন না কোনো বাস মালিকই। জায়গা ভেদে তারা ইচ্ছেমত বেশি ভাড়া আদায় করেন বলে যাত্রীদের অভিযোগ।
প্রায় বছর খানেক আগে সর্বশেষ বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সারা দেশে গণপরিবহনের ভাড়াও বাড়ানো হয়। তখন ঢাকা থেকে দূরপাল্লার পথে আগের তুলনায় বাড়ে ২২ শতাংশ ভাড়া। চালক ছাড়া ৪০ সিটের বাসে প্রতি কিলোমিটার পথের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ২ টাকা ১৫ পয়সা।
২০২১ সালে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর দূরপাল্লার বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালে আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে ৪০ পয়সা বাড়িয়ে করা হয় ২ টাকা ২০ পয়সা।
পরে আবার সেটি সমন্বয় করে ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর ৫ পয়সা কমিয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। যা এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। সে হিসেবে ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কিলোমিটার প্রতি দূরপাল্লার রুটে বাস ভাড়া বেড়েছে ৭৩ পয়সা।
দূরপাল্লার রুটে বাস যাত্রীদের অভিযোগ, প্রতিটি রুটের বাসে বেশি ভাড়া আদায় করা হয়। বিআরটিএ নির্ধারিত ৪৩২টি রুটের মধ্যে অন্তত ৪০টি রুটের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এতথ্য জানা গেছে। তাদের দেওয়া তথ্য ও বিআরটিএর তথ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক।
সাব্বির আহমেদ তিনি ঢাকায় এক বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। নিজের প্রয়োজনে তাকে প্রায় বাড়িতে যেতে হয়। তার বাড়ি ঝিনাইদহে। তিনি দর্শনা অথবা চুয়াডাঙ্গার পরিবহনে চলাচল করেন। তার কাছ থেকে ভাড়া রাখা হয় নন এসি ৬৫০ টাকা। অথচ এই ভাড়ায় দর্শনা বা চুয়াডাঙ্গার যাত্রীর কাছ থেকেও রাখা হয়।
অথচ তিনি প্রায় ৬২কিলোমিটার রাস্তা না যেয়েও পুরো রাস্তার ভাড়া দিতে বাধ্য হন। মি. সাব্বির জানালেন, গাবতলী থেকে দর্শনা ভায়া জীবনননগর বাস ভাড়া নন এসি ৬৫০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৪৫০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (গাবতলী) থেকে ঝিনেদা মোট রাস্তা ২১০ কিলোমিটার।
বিআরটিএর হিসাব মতো ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ৪৫১ টাকা। সেখানে নেওয়া হয় ৬৫০ টাকা। সাব্বির বলেন , বিআরটিএ ঘোষণা দিয়েই তাদের দায় শোধ করে থাকে। মনিটরিং করাকে তারা অপ্রয়োজন মনে করে। ফলে, দীর্ঘদিন ধরে এমন অনিয়ম চললেও তার অবসানে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়না।
তবে ভিন্ন বক্তব্য দিলেন রাজশাহীর আবু সালেহ সায়দাত। তিনি বলেন, গাবতলী থেকে রাজশাহী সদরের বাস ভাড়া নেয় ৭১০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৪৮০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (গাবতলী) থেকে রাজশাহীর (রুট-৮২) দূরত্ব ২৪৭ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ৭১২ টাকা। সে হিসেবে এই পথে ২ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে কম নেন বাস মালিকরা।
যদিও সরকার এসি বাস এবং ট্রাকের ভাড়া নির্ধারণ করে না। এসি বাসে যে যেমন সুবিধা দিতে পারে, সে তেমন ভাড়া নেবে।
আতিকুর রহমান মুন যিনি পরিবারিক প্রয়োজনে বরিশাল নিয়মিত যাতায়ত করেন। তিনি ভাড়ার বিষয়ে যা বললেন। সায়দাবাদ থেকে বরিশাল সদরের বাস ভাড়া নেয় বাস ভেদে ৫০০-৭০০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৪৫০-৫০০ টাকা।
অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (সায়দাবাদ) থেকে বরিশালের (রুট-৩৫) দূরত্ব ১৫৬ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ৫২৪ টাকা। সে হিসেবে এই পথে বাস ভেদে ১০০-২০০ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি নেন বাস মালিকরা।
সামিউল ইসলাম শোভন জানিয়েছেন সায়দাবাদ থেকে কক্সবাজার সদরের বাস ভাড়া নেয় ১২০০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৮০০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (সায়দাবাদ) থেকে কক্সবাজারের (রুট-৪৯) দূরত্ব ৩৯৬ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ১০৯৯ টাকা। সে হিসেবে এই পথে ১০১ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি নেন বাস মালিকরা।
যাত্রীদের দেওয়া তথ্য ও বিআরটিএর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন দূরত্বের দূরপাল্লার বাসগুলো ভাড়া বেশি আদায় করছে ।
কী বলছেন বাস মালিকেরা?
ঢাকা-সরিষাবাড়ী রুটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বাসের মালিক জানিয়েছেন, বিআরটিএর তালিকা অনুযায়ী ঢাকা (মহাখালি) থেকে সরিষাবাড়ীর (রুট-৭) দূরত্ব ১৬৬ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে আদায়যোগ্য ভাড়া ৪৫৫ টাকা। কিন্তু আমরা ওই সমপরিমাণ ভাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে নিতে পারি না। কারণ, এত টাকা ভাড়া দিয়ে কেউ যেতে চায় না।
অনেক লোকাল বাস আবার ৩০০ টাকাতে নিয়ে যায়। যার ফলে আমাদের ক্ষতি হয়। ওই পরিমাণ ভাড়া চাইলে ৪০ সিটের মধ্যে ৩০ সিটই খালি যাবে। তাও যাত্রী পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তাই আমরা ৩২০-৩৫০ টাকা নিয়ে থাকি। এতে বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া পূরণ না হলেও বাস খালি যায় না। হয়তো কখনও ৩/৪টা সিট খালি যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সরকার এসি বাস এবং ট্রাকের ভাড়া নির্ধারণ করে না। এসি বাসে যে যেমন সুবিধা দিতে পারে, সে তেমন ভাড়া নেবে। এসি বাস ২ কোটি টাকা দামেরও আছে আবার ৩ কোটি টাকা দামেরও আছে।তিনি আরও বলেন, সরকার নন এসি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়।
বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস এবিষয়ে বললেন। কোনো কোম্পানি চাইলে সরকার নির্ধারিত বাস ভাড়ার চেয়ে কম ভাড়া নিতে পারেন তবে কোনভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে পারেন না। বিষয়টি আমরা গুরত্ব সহকারে দেখব। কারণ, আমরা যখন ভাড়া নির্ধারণ করি তখন ম্যাক্সিমাম ভাড়াটাই নির্ধারণ করে থাকি।
এবি/ওজি