পরিবারে বাস করেন মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীসহ রক্তসম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় আপনজন। এদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য।
অনেক সময় বাবার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পদে ভাই-বোনদের, দাদার মৃত্যুতে তার ত্যাজ্য সম্পদে বাবা-চাচা ফুপুদের ন্যায্য প্রাপ্য অংশ দেওয়া হয় না। অনেকে সম্পত্তি দেওয়া তো দূরের কথা, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের প্রাপ্য রয়েছে বলেই মানতে চায় না।
অথচ এ অধিকার কোরআনে কারিমে নির্ধারিত। এই অধিকারকে মিরাস নামে অভিহিত করা হয়েছে।
মিরাস বা ত্যাজ্য সম্পদ বণ্টন একদিকে যেমন মানবাধিকার সম্পর্কিত, অন্যদিকে তা আল্লাহতায়ালার অপরিহার্য নির্দেশ। মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদে সুষ্ঠু বণ্টন ফরজ আমল, এর ব্যত্যয় গোনাহের কাজ।
বোনের উত্তরাধিকার সম্পত্তি গ্রাস করা যাবে না; পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন- ‘আত্মীয়স্বজনকে তার অধিকার দিয়ে দাও’ (সূরা বনি ইসরাইল-২৬)। বড়ই আফসোস ও পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে অধিকাংশ ভাইয়েরা ছলেবলে-কৌশলে বোনদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, ভাইয়ের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থ-সম্পদ নেয়াকে সমাজের চোখে ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখা হয়। শুধু তাই নয়, কোথাও কোথাও সমাজে এই কুপ্রথাও প্রচলিত আছে যে, বোন বাবার বাড়ির সম্পদ নিলে আর বাবার বাড়ি আসতে পারবে না! তাই অনেক বোন প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও সম্পদ নেয় না শুধু বাবার বাড়ি হারানোর ভয়ে। এর চেয়ে নিকৃষ্ট, জাহেলি প্রথা আর কী হতে পারে। এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।
অথচ রাসূল সা: তো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধিকার সম্পত্তি গ্রাস করে, অন্য বর্ণনা মতে, যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধিকারী সম্পত্তি থেকে পলায়ন করায়, আল্লাহ তাকে জান্নাতের অংশ থেকে বঞ্চিত করবেন’ (ইবনে মাজাহ ও মিশকাত)।
আমাদের ভাইবোনদের সম্পর্ক মধুর করতে যে বিষয়গুলো লক্ষ রাখা উচিত-
১. শ্রদ্ধা-স্নেহের ভারসাম্য : যত ঘনিষ্ঠই হোক ভাইবোনের মধ্যে বড়কে সম্মান ও ছোটকে স্নেহ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে ছোটকে স্নেহ ও বড়কে সম্মান করে না’ (সুনানে তিরমিজি-১৯১৯)।
২. উত্তম আচরণ : ভাইবোন ও পরিবারের সদস্যরাই উত্তম আচরণের বেশি দাবি রাখে। সুতরাং ভাইবোন পরস্পরের সাথে বিনয়, অগ্রাধিকার প্রদান, সেবা, সহযোগিতা ও হৃদ্যতার সম্পর্ক রাখবে। কেননা, আল্লাহর নবী সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আমি আমার পরিবারের কাছে উত্তম ব্যক্তি’ (সুনানে তিরমিজি-৩৮৯৫)।
৩. অবহেলা না করা : এমন যেন না হয় যে, সুযোগ পেলে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হয় অথচ কয়েক বছরেও বোনের বাড়ি যাওয়া হয় না। বোনের তেমন খোঁজ-খবরও নেয়া হয় না। সমাজে দেখা যায় খালাদের তুলনায় ফুফুরা একটু বেশিই অবহেলিত। এই প্রান্তিকতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
৪. হাদিয়া দেয়া : ভালোবাসা, মুহাব্বত বৃদ্ধি ও সম্পর্ক উন্নয়নের অন্যতম উপায় হলো হাদিয়া দেয়া। তাই তো প্রিয় নবী সা: বলেছেন, ‘বেশি বেশি তোহফা দাও ভালোবাসা বাড়াও’ (জামে তিরমিজি)।
৫. অন্যের জন্য ভালো চাওয়া : মুমিন নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অন্যের জন্য তাই পছন্দ করে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে’ (বুখারি-১৩)। সুতরাং ভাইবোনদের উচিত, তাদের সাধ্যমতো একে অপরকে উত্তম জিনিসই হাদিয়া দেয়া।
৬. দুঃখ-সুখের অংশীদার হওয়া : ভাইবোন পরস্পরের দুঃখ ও সুখের অংশীদার হবে। একে অন্যের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেবে। দুঃখের সময় নিছক সান্ত্বনা দেয়া পুণ্যের কাজ। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন পুণ্যের কাজকে অবজ্ঞা না করে। যদিও তা তার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা হোক’ (মুসলিম-২৬২৬)।
৭. নম্র স্বরে কথা বলা : কেউ কাউকে কথা দিয়ে আঘাত না করা। পরস্পরে কথাবার্তার ক্ষেত্রে নম্র হওয়া, এতে পরিবারে শান্তি আসে। কেউ ভুল পথে গেলে ভালোবেসে শান্তভাবে নম্র ভাষায় বোঝাতে হবে।
সঠিক পথে আনার চেষ্টা করতে হবে। অযথা উত্তেজিত হওয়া যাবে না। হাদিসে এসেছে- ‘আল্লাহ যখন কোনো পরিবারের কল্যাণ চান, তখন তাদের কোমলতা দান করেন। আর যখন কোনো পরিবারের অকল্যাণ চান, তখন তাদের থেকে কোমলতা উঠিয়ে নেন’ (মুসনাদে আহমদ-২৩২৯০)।
৮. সুপরামর্শ দেয়া : ভাইবোন পরস্পরের শুধু আপনজন নয়; বরং তারা পরস্পরের ভালো বন্ধুও। বন্ধু হিসেবে তারা কখনো কখনো পরস্পরের পরামর্শ চায়, কখনো তাদের সুপরামর্শ দেয়ার প্রয়োজন হয়। সুপরামর্শ দেয়া ভাইবোনের দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন- ‘তোমার পরিবারবর্গকে নামাজের নির্দেশ দাও এবং তাতে অবিচল থাকো’ (সূরা ত্বহা-১৩২)।
৯. অন্যায় থেকে বাঁচিয়ে রাখা : ভাইবোনের কেউ অন্যায় করলে যেমন বাধা দিতে হবে, তেমনি তার প্রতি অন্যায় হলেও প্রতিহত করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে অত্যাচারী হোক বা অত্যাচারিত হোক।’ আনাস রা: বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, অত্যাচারিতকে সাহায্য করব, তা তো বুঝলাম কিন্তু অত্যাচারীকে কী করে সাহায্য করব? তিনি বললেন, ‘তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে’ (বুখারি-২৪৪৪)।
১০. সম্পর্ক নষ্টকারী অভ্যাস পরিহার করা : মানুষের কিছু স্বভাব-চরিত্র পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে। এমন স্বভাব-চরিত্র পরিহার করা আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা (অধিক পরিমাণ) ধারণা করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, ধারণা করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যা। কারো দোষ অনুসন্ধান করো না, দোষ বের করার জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করো না, একে অন্যের হিংসা করো না, পরস্পরে সম্পর্কচ্ছেদ করো না। ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও’ (বুখারি-৬৭২৪)।
এবি/ওজি