আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন আজ। দিনটিকে ঘিরে দেশজুড়ে নেতাদের সতর্কবার্তা দিয়েছে বিএনপি। নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো ‘কৌশল বা ফাঁদে’ না পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রার্থিতার যোগ্যতা সম্পন্ন নেতাদের প্রয়োজনে ‘আত্মগোপনে’ যাওয়া পরামর্শও দিয়েছে দলটি।
যদিও বড় মাপের কোনো নেতাই এখন পর্যন্ত পা বাড়ায়নি নির্বাচনের দিকে। তবে তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ‘কাঁপন’ ধরিয়ে দিয়েছিল দলের মধ্যে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের তৈমুর আলম খন্দকারের তৃণমূল বিএনপিতে যাওয়াটা বিস্ময়ের পাশাপাশি উদ্বেগও তৈরি করেছিল বিএনপির সর্বস্তরে।
আশঙ্কা ছিল ‘মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত কিংবা বিরোধী রাজনীতিতে ক্লান্ত’ হয়ে পড়া নেতাদের কেউ কেউ ভিন্ন দলের ব্যানারে নির্বাচনে যেতে রাজি হয়ে যান কি না। এমন উদ্বেগের প্রধান কারণ ছিল নতুন ওই দুই দলের উদ্যোক্তারা কিছুদিন আগেও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এছাড়া নতুন দলগুলো গঠনের আগে বলা হয়েছিল বিএনপির অনেক নেতা তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন কিছু না হওয়ায় স্বস্তির বাতাস বইছে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এই দলটিতে।
বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, মূলত বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি গঠনের পর থেকেই সতর্ক ছিলেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এরপর থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ দলের সিনিয়র নেতারা কয়েকজন দলীয় নেতার সঙ্গে দফায় দফায় কথাও বলেছেন।
ড. আব্দুল মঈন খান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। সিনিয়র এই রাজনীতিবিদ বলেন, বর্তমান সরকার গেল ১৫ বছরে ভিন্ন ভিন্নভাবে বিএনপিকে ভেঙে-চুরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ১৫ বছরে ১৫ জন তো দূরে থাক, বিএনপির একজনও গুরুত্বপূর্ণ নেতাকেও দলে ভেড়াতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘হর্স ট্রেডিং করে সরকার হয়তো একটি সাজানো সংসদ তৈরির প্রয়াস পেতে পারে। তবে সরকারের অল্টারনেট গণতন্ত্রের স্বপ্ন এই প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হবে না’। অর্থাৎ কোনো চাপেই নেতারা বিএনপি নেতারা দল ছেড়ে যাবে— এমন আশঙ্কা তাদের মধ্যে এখন আর নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, বিএনপিতে প্রার্থী হওয়ার মতো যোগ্য নেতাদের বেশিরভাগই বহু বছর ধরে নির্যাতিত। অনেকেই আবার কারাগারে।
তিনি বলেন, দলের হাইকমান্ড জানে তারা আপস করবে না। তাদের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচনে যাওয়া যাবে না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিএনপি নেতা কায়সার কামাল বলেন, নির্বাচনকে ভাঙা বা দল থেকে লোকজন ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হবে। বিএনপি নেতৃত্ব আগে থেকে এই ধারণা করছিলেন। এজন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আগে থেকেই কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি দলের প্রতিটি স্তরের নেতাদের সাথে কথা বলেছেন, আশ্বস্ত করেছেন। নেতারাও তার প্রতি আস্থাশীল। এ জন্যই দল থেকে গুরুত্বপূর্ণ কেউ সরে যায়নি।
তবে বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, মূলত শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সাথে সাথেই দেশজুড়ে দলের প্রার্থী হতে পারেন এমন নেতারা ‘আত্মগোপনে’ চলে যান। আবার কেউ কেউ আগেই ‘চাপ এড়াতে’ মামলায় আত্মসমর্পণ করে কারাগারে চলে যান। বিশেষ করে সাবেক এমপি ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের সতর্কবার্তা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিএনপি ভাঙার চেষ্টার অভিযোগ বরাবরের মতোই অস্বীকার করেছে ক্ষমতাসীনরা। মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমার কাছে তথ্য আছে, তারেক রহমানকে যারা নেতা মানতে পারছেন না, তার লিডারশিপ মানতে যাদের কষ্ট হচ্ছে, তারা অনেকে নির্বাচনে আসবে। নির্বাচনে আসার জন্য তারা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মও তৈরি করেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা দেখেছেন, বিএনপির যে রাজনীতি, যে নেতৃত্ব, তা তাদের অনেকের পছন্দ হচ্ছে না। ফলে তারা নতুন দল তৈরি করেছেন। আমরা শুনছি বিএনপির অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন।
বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর)। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। এখনো উদ্বেগ আছে অনেকের মধ্যে। তাই অনেক নেতাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। আত্মগোপনে আছেন এমন নেতাদের ফোনও বন্ধ রাখা হয়েছে। যেন কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে।
সেলিমা রহমান বলেন, নেতারা জানেন তাদের কী করতে হবে। কীভাবে সব ষড়যন্ত্র, চাপ মোকাবেলা করতে হবে। এরপরেও যারা নির্বাচনের দিকে ঝুঁকেছেন তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কড়া ভাষায় ভিডিও বার্তা দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও।
বিএনপির সিনিয়র এই নেত্রীর কথার সঙ্গে মেলালে দেখা যায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান, ধামরাই পৌরসভা বিএনপির সভাপতি দেওয়ান নাজিম উদ্দিন মঞ্জু, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও রাজশাহী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু, ফরিদপুরের শাহ আবু জাফরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া দলের আরও কয়েকজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে আলোচনায় এসেছেন।
এর মধ্যে আছেন সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, দলের বহিষ্কৃত নেতা শওকত মাহমুদ, চট্টগ্রাম বিএনপির সাবেক নেতা নাজিম উদ্দিন, বগুড়ার মোহাম্মদ শোকরানা, বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বিউটি বেগম।
বিএনপি নেতারা বলছেন, ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব আছে এমন নেতাদের নামেই দল ছাড়ার গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল। তাদের প্রায় সবার সাথেই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আলাদা করে কথা বলেছেন। তারা দল না ছাড়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। মূলত এসব কারণেই দলের জেলা, উপজেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রার্থী হওয়ার মতো প্রায় সবাই এখন আত্মগোপনে।
সূত্র: বিবিসি
আমার বার্তা/জেএইচ