বর্তমান বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এক আধুনিক বিশ্ব। সমাজ ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি এনেছে এক অভাবনীয় পরিবর্তন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার পথে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ আমাদের দেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ এরপর স্মার্ট বাংলাদেশ এর পরিকল্পনা এই শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মনে করছেন দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা। স্মার্ট বাংলাদেশের এই রূপরেখা কে চার ভাগে ভাগ করে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের জন্য চারটি ভিত্তির মধ্যে রয়েছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনোমি, স্মার্ট গভমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের এই ভিত্তি গুলোর মধ্যে "স্মার্ট সোসাইটি" ধারণাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সমস্ত সমাজকে স্মার্ট সমাজ হিসেবে গঠন করতে হলে অবশ্যই সেই সমাজের সামাজিক সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে। সেটি সমাজকর্মের গ্র্যাজুয়েটরা "Social Problems and Techniques of Problem Analysis"পঠিত বিষয়ের মাধ্যমে খুব সহজেই করে ফেলতে পারে। আমাদের সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন ধরেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমস্যাগুলো বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে মাদকের সহজলভ্যতা, খুন, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, যৌন নিপীড়ন, মানবাধিকার ও নিরাপত্তা জনিত সমস্যার মত হাজারো সমস্যা। এসব সমস্যার ফলে আমাদের সমাজের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে সামাজিক অবক্ষয়। সমাজে বিদ্যমান এসকল সমস্যার সমাধান না করে "স্মার্ট সোসাইটির" স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা অলীক। তবে এ সকল সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন পেশাদার সমাজকর্মী। একজন দক্ষ সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করতে হলে প্রথমত প্রয়োজন বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান। আর সমাজকর্ম হলো সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মধ্যে অন্যতম একটি প্রায়োগিক বিষয়। এছাড়াও এটি আন্তর্জাতিক তথা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে একটি সমাদৃত বিষয়। সমাজকর্ম হল অনুশীলন ভিত্তিক ও পদ্ধতি নির্ভর মানবীয় সম্পর্ক বিষয়ক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দক্ষতা ভিত্তিক এক পেশাদার সেবাকর্ম। এটি ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টিগত পর্যায়ে নানাবিধ মনো-সামাজিক সমস্যা দূর করে সমাজের কাঙ্খিত, ইতিবাচক ও গঠনমূলক পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ ও সমাজের মানুষের চিত্র বদলে দেয় এবং প্রত্যেককে তার অবস্থান অনুযায়ী সামাজিক ভূমিকা পালনের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে সহায়তা করে। বাংলাদেশে সমাজকর্মের আবির্ভাব পঞ্চাশের দশকের শুরুতে হলেও বৈশ্বিকভাবে ১৮৯৮ সালে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পঠিত হয় সমাজকর্ম বা আধুনিক সমাজ কল্যাণ।বিষয়বস্তু হিসেবে সমাজকর্ম যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ও বৈচিত্র্যময়। কেননা সমাজকর্ম বিষয়টি শুধু সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ বিষয়ের সঙ্গে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, আইন, মনোবিজ্ঞান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন সমাজকর্মী যে ইস্যু নিয়ে কাজ করবেন সেই ইস্যুতে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। এর ফলে সমস্যা সমাধানে তিনি তার বৈজ্ঞানিক ও গবেষণা নির্ভর জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারবেন। সমাজকর্মের নীতিগত ও কর্মমুখী পেশাদারিত্ব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগের মাধ্যমে একটি সমাজের ভিত্তিমূল তৈরি হয়। আধুনিক বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি বিষয় হচ্ছে পেশা কেন্দ্রিক। তার মধ্যে সমাজকর্ম অন্যতম। সমাজের ভিত্তি স্থাপন ও কাঠামোগত ভিত মজবুত করে সমাজকর্মীরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সঠিক পরিচর্যা ভিত্তি গঠিত হয় সমাজকর্মীর মাধ্যমে। সমাজের বিশেষ লক্ষ্য পুরনো চিহ্নিত সমস্যা সমাধান করে একটি আদর্শ সমাজ গঠন করাই হচ্ছে সমাজকর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য। উন্নত বিশ্বে এই কাজগুলো সম্পাদন করে একজন পেশাদার সমাজকর্মী। যার ফলস্বরূপ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে সামাজিক সমস্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যে দেশগুলোতে অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে।যার দরুন ঐ সকল দেশের পুনর্বাসন ও অপরাধ নির্মূল কেন্দ্রের কার্যক্রম ধীরে ধীরে স্থগিত করে দেয়া হচ্ছে। সেই সমস্ত দেশগুলোকে এই অবস্থানে নিয়ে আসার মূল কারিগর হলো পেশাদার সমাজকর্মীরা। প্রতিবছর মার্চ মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার সমাজকর্মের প্রচার, প্রসার ও মানব সম্পর্কের উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস। এ বছর " Respecting Diversity Through Joint Social Action" শ্লোগানকে সামনে রেখে পালিত হয়েছে বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও প্রতিবছর সরকারি, বেসরকারি পর্যায় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন করা হয় বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস। তবে আমাদের দেশে সমাজকর্ম বিষয় চালুর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সমাজকর্মের পেশাগত স্বীকৃতি মেলেনি। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে "স্মার্ট সোসাইটি"গঠনে উন্নত বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও সমাজকর্ম কে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করি। সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রভৃতি মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম সমাজকর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং এ মন্ত্রণালয়গুলোর নিয়োগ পরীক্ষায় সমাজকর্মের গ্রাজুয়েটদের প্রাধান্য দেওয়া দেওয়া উচিৎ।সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সমাজকর্মে গ্র্যাজুয়েটদের জন্য উচ্চ শিক্ষা অর্জনে স্কলারশিপ চালু করা প্রয়োজন।
এছাড়াও প্রতিটি সমাজকর্মী কে সরকারিভাবে নিবন্ধিত হওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যার দরুন একজন সমাজকর্মী ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডাক্তার, প্রকৌশলী ও শিক্ষকের ন্যায় সমাজের গঠনগত পরিবর্তন করে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করতে পারে। ঠিক তখনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে চারটি স্তম্ভ তার মধ্যে অন্যতম "স্মার্ট সোসাইটি" ধারণাটি পূর্ণতা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।