ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী একটি শুধু নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। স্বার্থপর সমাজ ও রাষ্ট্রের এক দলীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিরামহীন লড়াই করা এক নি:স্বার্থ ব্যক্তি।
দেশের ক্রান্তিকালে মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি।বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি আলোকিত অধ্যায় রচনা করেছেন তিনি।
ডাঃ জাফরুল্লাহর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। তাঁর বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়।
ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় তিনি মেধার পরিচয় দিয়েই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু এফআরসিএস পড়াকালীন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চূড়ান্ত পর্ব শেষ না-করে লন্ডন থেকে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার নিমিত্তে আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন ।
তিনি যে যেতে চান বাংলাদেশ নামক নতুন এক দেশ সৃষ্টির লড়াইয়ে সূর্য রং কোন এক ভোরের আসরে। প্রশিক্ষণ শেষেই তিনি প্রবেশ করেন যুদ্ধের দেশ বাংলাদেশে। মুক্তিবাহিনীর একজন যোদ্ধা হিসাবে তিনি লড়াই করেন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে।
আগরতলায় তিনি পেয়ে গেলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক জিএস ডাঃ এম এ মবিনকে। তার সাথে মিলেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট “বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল” প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা শুরু করলেন।
টগবগে যুবক ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া ছাড়াও আরেকটি কাজ শুরু করলেন। যুবক স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য জ্ঞান দান করেন যা দিয়ে তারা নার্স হিসাবে রোগীদের সেবা করত এবং তার এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার “ল্যানসেট”-এ প্রকাশিত হয়।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং গণবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।
এছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে রামন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড (১৯৯২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন।২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার পান।
আমার সাথে যেভাবে পরিচয়:
আমি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী কে সেই স্কুল জীবন থেকে চিনি মিডিয়ার কল্যাণে। দেশের ক্রান্তিকালে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিঃস্বার্থভাবে অবদান রাখার চেষ্টা করতেন।টিভি টকশোতেও ছিলেন আলোচিত বক্তা।
২০১৬ সালের মে মাসের শুরুতে এলিফ্যান্ট রোডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর এমাজউদ্দীন আহমেদ এর স্ত্রীর কুলখানিতে প্রথম এই মানুষটির সাথে সরাসরি দেখা হয়। দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে তিনি টেলিটক সিম ব্যবহার করতেন। কুলখানি শেষে হঠাৎ দেখলাম তিনি মোবাইলে জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছেন। আমি কিছুটা অবাক! কারণ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার "কোন টান" তার কথায় নেই। জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে কথা শেষ হলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার বাড়ি চট্টগ্রামের কোন জায়গায়? তিনি বললেন রাউজান।
আমি বললাম আমি জানতাম না যে আপনার বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। কারণ আপনার মাঝে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার কোন 'টান' নেই। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
তোমার বাড়ি কোথায়? আমি বললাম কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলায়।
এরপর মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতো। দেড় মাস পর ২০১৬ সালের ১৭ জুন দুপুর বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর মনিরুজ্জামান মিয়ার জানাজার আগে এই বরেণ্য ব্যক্তির সাথে আবার দেখা হয়।
সাথে ছিলেন আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ,বীর চট্টলার আরেক কৃতি সন্তান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। জিল্লুর রহমানের সামনেই জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা শুরু করলাম।
আমরা তিনজনই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা উপভোগ করলাম। কারণ ঢাকা শহরে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারা এবং মনের ভাষা বোঝাতে পারা অনেক তৃপ্তির।সময়ের প্রয়োজনে ঢাকা শহরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের অনেক সময় দেখা হয়েছে এবং কথা হয়েছে।
কিন্তু সম্পর্ক বলতে আমরা একজন আরেকজন কে "ভালোভাবে" হিসেবে চিনি এতটুকুই।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান:
২০১৮ সালের ৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে নুরুল হক নুরের উপর হামলার পর কোটা সংস্কার ১ জুলাই আন্দোলনের নেতা রাশেদ খান এবং ২ জুলাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ফারুক হাসান সহ কয়েকজন নেতাকর্মী কে আটক করে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
এতদিন ধরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে হাজার হাজার নেতাকর্মী ছিল। কিন্তু পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলার ঘটনায় ভয়ে অনেকেই আড়ালে চলে যায়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের চরম দুর্দিনে ৩ জুলাই আমি হাজির হলাম ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ধানমন্ডির অফিসে। তাকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সর্বশেষ আপডেট জানালাম। আমি তখনও মিডিয়ার কর্মীর পাশাপাশি আন্দোলনের কর্মী।আন্দোলনের নেতা নয়।
তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কৌশলগত কারণে কমিটিতে আমার নাম না রাখলেও শীর্ষ নেতাদের অনেকেই আন্দোলনের প্রয়োজনে আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো।
৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে নুরুল হক নুর কে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলার মুখে ফেলে অনেকেই চলে যায়। আমি নুরুল হক নুর কে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলা থেকে রক্ষা করতে চ্যাংদোলা করে লাইব্রেরীর ভেতরে নিয়ে যায়।
নুর সহ আহতদের উদ্ধার এবং চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি তাদের কে প্রয়োজনমতো সহযোগিতা করেছি। কিন্তু একজন ব্যক্তির সহায়তায় তো আন্দোলন টিকিয়ে রাখা কঠিন। তখন ৫/৬ জন শীর্ষ নেতা জেলহাজতে এবং নুরুল হক নুর ও হাসান আল মামুন আত্মগোপনে। আন্দোলনের মাঠে কেউই নেই।
আমি জাফরুল্লাহ চৌধুরী কে বললাম আন্দোলনে আপনার সহযোগিতা একান্ত দরকার। না হলে এই আন্দোলন টিকিয়ে রাখা কঠিন। আপাতত চিকিৎসা সেবা আমাদের কে দেন।
সেই সময় নুরুল হক নুর (পরে ডাকসু ভিপি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম সহ আন্দোলনের অনেক সহযোদ্ধা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছে। সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও চিকিৎসার দিচ্ছে না।
অসুস্থ অবস্থায় তারা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। আমাদের পক্ষে বেশিদিন চিকিৎসার খরচ বহন করা সম্ভব নয়। তাই আপনার এখানে তাদের চিকিৎসা দরকার। আন্দোলন টিকিয়ে রাখতে ভবিষ্যতে আরও সহযোদ্ধা আহত হতে পারে। তাই আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিন।
ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী তখনও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নুরুল হক নুর, রাশেদ খান, ফারুক হাসান, হাসান আল মামুন সহ
কাউকে চিনে না।তাই আমার অনুরোধে সাড়া দিলেন।তাই তিনি বললেন, "আমি অফিসে বলে দিচ্ছি তোমার রেফারেন্স দিয়ে অথবা কোটা সংস্কার আন্দোলনের কোনো কর্মী
আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসলে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে। তিনি আমার সামনেই হাসপাতালের পরিচালক কে বলে দিলেন। পরে আমি তার সাথে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর রেফারেন্স দিয়ে কথা বলি।
তিনি আরো বলেন ,"আমি 'স্যার' সম্বোধন করা পছন্দ করি না। আমাকে "বড় ভাই" বলে ডাকবে।তখন থেকেই আমি তাকে বড় ভাই বলে ডাকি।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে
বৈঠক শেষে আমি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা সবার উদ্দেশ্যে জানিয়ে দিলাম। আমারই বিভাগের এক ছোট ভাই আমার এবং ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর যৌথ ছবি তুলেছেন। আমি সেই ছবি সহ ফেসবুকে পোস্ট করলাম। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিচে অফিসে গিয়ে হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী একটি স্বাস্থ্য বীমার চেক বই ইস্যু করলাম।
সেইদিন আমার সাথে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর যে স্বাস্থ্য বীমা চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তি অনুযায়ী এখনো ছাত্র অধিকার পরিষদের কেউ অসুস্থ হলে গণস্বাস্থ্য নগর কেন্দ্র হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং চিকিৎসা সেবা নেয়। আমিও অন্তত দুইবার চিকিৎসা সেবা নিয়েছি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাঝখানে ২০১৮ সালে ২৯ জুলাই শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী
রাজীব এবং দিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাদের মৃত্যু কে কেন্দ্র করে "নিরাপদ সড়ক চাই" আন্দোলন শুরু হলে আমি আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে আন্দোলন কে চাঙ্গা করতে চাইলাম। সেদিন অনেক সিনিয়র নেতাদের পিছুটান দেখেছি।
নুরুল হক নুর এবং হাসান আল মামুন কথা দিয়েও জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্সে আসে নাই। অবশেষে ৩ আগস্ট রোজ শুক্রবার বিকেলে আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই বিন ইয়ামিন মোল্লাকে নিয়ে আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রেস কনফারেন্স করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে আমরা মাঠে নামি।
৬ আগস্ট গভীর রাতে গাজীপুর থেকে রাতুল সরকার কে আটক করে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তাকে তিন দফা রিমান্ডে নেয়া হয়। থানা,আদালত, কারাগার ও রাজপথে দৌড়াদৌড়ি করছে করতে আমার শরীর ভেঙে পড়েছে। এদিকে
ঈদুল আজহা আসন্ন হওয়ার কারণে আমাদের পক্ষে আন্দোলন টিকিয়ে রাখা কঠিন। তাই ঈদ উপলক্ষে একটু বিরতি দেয়া দরকার।
আমিও একসময় লেখালেখি সংক্রান্ত মামলায় জেলখানায় বন্দী ছিলাম। তখন দেখতাম দুই ঈদের সময় আদালত বেশি সংখ্যক আসামি কে জামিন মঞ্জুর করে।
আমি চিন্তা করলাম এটাই মোক্ষম সুযোগ আটক নেতাকর্মীদের মুক্ত করার। তাই নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে আমরা ১২ আগস্ট শাহবাগ জাদুঘরের সামনে সমাবেশ করে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত
আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করি।এটাও ছিল আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে একটা কৌশল। আমি বিন ইয়ামিন মোল্লাকে দুইটা আল্টিমেটাম শিখিয়ে দিয়েছিলাম।
প্রথম আল্টিমেটাম: ঈদুল আজহার আগেই মুক্তি যাতে আটক নেতাকর্মীরা জেলখানা থেকে বের হয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারে। ঈদের আগে মুক্তি না দিলে জেলখানার ভিতরে আটক নেতাকর্মী এবং বাইরে আমাদের নেতা-কর্মীরা কালো পোশাক পরিধান করে ঈদ উদযাপন করবে। আমি আমাদের সহযোদ্ধা আতা ভাই কে বঙ্গবাজারে গিয়ে কালো পাঞ্জাবি কিনতে বললাম।
২য় আল্টিমেটাম: ঈদের আগেই
কারাগারে আটক নেতাকর্মীদেরকে মুক্তি না দিলে ২৭ আগস্ট কোর্টে জামিন শুনানির দিন তাদের জামিন দিতে হবে। সে জন্য
৩১ আগস্ট পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিতে হবে।এই সময়ের মধ্যে মুক্তি না দিলে সেপ্টেম্বর মাসে কঠোর আন্দোলন শুরু।
বিন ইয়ামিন মোল্লা আল্টিমেটাম ঘোষণা করতে গিয়ে প্রথম আল্টিমেটাম ভুলে গিয়েছিল। প্রথম আল্টিমেটাম ঘোষণা না করেই দ্বিতীয় আল্টিমেটামে চলে গেল। তাই আমি তাকে প্রথম আল্টিমেটাম স্মরণ করিয়ে দিলাম। তাই দ্বিতীয় আল্টিমেটাম ঘোষণা করার পর বিন ইয়ামিন মোল্লা প্রথম আল্টিমেটামটি ঘোষণা দিলেন।
আমাদের আল্টিমেটাম শুনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মাথা ঘুরে গেল। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, "শেখ হাসিনার কাছ থেকে আল্টিমেটাম দিয়ে কোন কিছুই আদায় করা সম্ভব নয়"।
আন্দোলন ঠেকাতে সরকার অপতৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। এটা শুনে আমরাও শক্তি সঞ্চয় করতে একদিন আমি ছুটে গেলাম নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের জন্য লড়াই করা এক ব্যক্তির কাছে।
আমি সেগুনবাগিচায় তার অফিসে দেখা করলাম। আমি চেয়েছিলাম আমরা যৌথভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে একসাথে কাজ করতে। কিন্তু তিনি তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন এবং আমাদের প্রতি সরকারের নেতিবাচক মনোভাব স্মরণ করিয়ে দিলেন।
ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের তীব্র সমালোচনা করতেন । তাই আমাদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কিছু নেতার ভাষ্য ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাফরুল্লাহ চৌধুরী কে সম্পৃক্ত করা যাবে না। কিন্তু আমি তাদের কে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী কে আমরা কাজে লাগাতে পারি।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সরকার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি কে মামলা হামলা চালিয়ে অপদস্থ করেছে। তাই বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী নিশ্চুপ এবং নীরব হয়ে গেছে। আমি চিন্তা করলাম এই মুহূর্তে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছাড়া আমাদের কে সহযোগিতা করার সাহস কেউ দেখাব না। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে মোবাইলে খোলামেলা কথা বলা যায় না।
তাই নিরিবিলি পরিবেশে কথা বলতে চাইলাম। তিনি আমাকে ১৫ আগস্ট সকালে তার বাসায় যেতে বললেন।
দুর্ভাগ্য বশত ১৫ আগস্ট সকালে সিরাজগঞ্জের এক অজপাড়া গাঁ থেকে আমাদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী এবং ইডেন কলেজের ছাত্রী লুৎফুন্নাহার লুমা (নীলা) কে পুলিশ আটক করে।
পুলিশ তাকে আটক করার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি মিডিয়ার মাধ্যমে নীলা কে পুলিশ আটক করার বিষয়টি খোলাসা করলাম। সেই সময় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল থেকে শুরু করে অনেকেই দায়সারা মনোভাব দেখিয়েছেন।
আমি দেখেছি আন্দোলনের দুর্দিনে অনেক ছাত্র ছাত্রলীগ ও পুলিশের ভয়ে দূরে থাকলেও ছাত্রীদের অনেকেই সরব ছিলেন। কিন্তু নীলাকে আটকের ঘটনায় অনেকেই ভয় পেয়ে গেছেন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে একজন বললেন বড় ভাইয়ের বাসা ধানমন্ডি মিনাবাজারে। কিন্তু আমি মিনা বাজারে পৌঁছে বড় ভাইয়ের বাসা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একজন চায়ের দোকানদার বললেন যে ঐ যে পরিত্যক্ত বাসা দেখা যাচ্ছে ঐটাই ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বাসা। বাসায় ঢুকে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী কে আন্দোলনের সর্বশেষ আপডেট জানালাম।
একজন মেয়ে কে আটক করায় আন্দোলনে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী কে জানালাম।
কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির ফায়সালা করতে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সহায়তা চাইলাম। তাকে বললাম আমি বাংলা সিনেমার একজন নায়কদের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার কথা শুনে মনে হয়েছে তিনি সিনেমায় যেভাবে মারামারি করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, বাস্তবে তার কিছু্ই না!
ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
আমি বললাম নেতাকর্মীদের জামিন শুনানি ২৭ আগস্ট। কিন্তু তার আগেই ফাইল পুট আপ (File put up ) করে জামিন নেওয়া সম্ভব। ঈদের কারণে আদালত বিবেচনা করতে পারে।
ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিঃস্বার্থভাবে আমাদের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেন। তিনি আমার সামনেই সরকারের এক উপদেষ্টার সাথে কথা বললেন। পরেরদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে দেখা করার কথা বললেন। পরের দিন সকালে ১৬ আগস্ট আমি আটক নেতাকর্মীদের খোঁজ খবর নিতে কেরাণীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গেলাম।
নেতাদের সঙ্গে কৌশল বিনিময়ের পর পুরান ঢাকার জজ আদালতে আসলাম। কারণ সেদিন নীলাকে আদালতে হাজির করার কথা। নির্ধারিত সময়ে নীলা কে পুলিশ আদালতে হাজির না করায় আমরা ফেরত আসছিলাম। ঠিক এই সময়ে নিচে নামতেই দেখি নীলাকে পুলিশ নিয়ে আসছে। এরপর আদালতে দুই পক্ষের আইনজীবীদের আইনী লড়াই শেষে তাকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হলো।
সরকারের লিঁয়াজো চলাকালীন সময়ে নীলার এই রিমান্ড আমি মানতেই পারলাম না। সেদিন আমি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাইলাম। তিনি বললেন যে আগামীকাল( ১৭ আগস্ট )সকালে এবং বিকালে আমাদের সমর্থনে আয়োজিত পৃথক দুটি অনুষ্ঠানে তিনি থাকবেন।
১৭ আগস্ট কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। কারণ এই দিনে কারাগারে আটক নেতাদের মুক্তির সমর্থনে পৃথক চারটি প্রোগ্রাম হয়েছিল।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল চারটি প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকার। ১৭ আগস্ট সকালে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন মিলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করে।এই মানববন্ধনে আটক নেতাকর্মীদের পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যরাও বক্তব্য রাখেন।
ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং তার সহধর্মিণী শিরীন হক সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতাকর্মীরা এই মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন।
আমরা একটি মেসেজ সেদিন সরকারকে দিতে পেরেছিলাম যে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সম্পৃক্ত কেউই সরকার বিরোধী কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত নয়। আমরা শুধু মাত্র দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করেছি । অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয় ।
১৭ আগস্ট বিকাল তিনটায় নীলার মুক্তির দাবিতে আমাদের পূর্ব নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন।একই সময়ে আমাদের সমর্থনে দুপুর আড়াইটা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার (পরে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট) একটি সংহতি প্রকাশ অনুষ্ঠান যেখানে ডক্টর কামাল হোসেন,ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী অনেকেই বক্তব্য রাখবেন।
অনুষ্ঠানের শেষে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখেন। এটাই নিয়ম। তাই আমি অনুষ্ঠানের শুরুতেই ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হানিফ ভাই কে অনুরোধ করেছি। তিনি বললেন যে তাহলে তাদের কে দ্রুত নিয়ে আসেন। কিন্তু নীলার মা এবং বোন আসতে একটু দেরি হয়ে যায়। তাই আমি এই সময় সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য এবং আন্দোলনের কিছু ছবি প্রিন্টিং করতে তোপখানা রোডে চলে যায়।
বিকাল তিনটায় নীলার মা এবং বোন আসলেন।চিন্তায় পড়ে গেলাম তাদের কে নিয়ে আগে কোন অনুষ্ঠানে যাবো। কারণ নেতাকর্মীদের মুক্তির ফায়সালা করতে জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ডক্টর কামাল হোসেনের সামনে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য দেওয়া জরুরি। তাই আমি নীলার মা এবং বোন কে নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সংহতি প্রকাশ অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলাম। উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই আমি হানিফ ভাই কে অনুরোধ করলাম আমাদের আরও একটি অনুষ্ঠান আছে ক্রাবে। তাই একটু আগেই সুযোগ দিতে হবে।
ঠিক এই সময়ে আতা ভাই কল দিলেন নীলার মা এবং বোন কে নিয়ে ক্রাবের সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার জন্য। আমি বললাম নেতাকর্মীদের মুক্তির জন্য সংবাদ সম্মেলনের চেয়ে এই সংহতি প্রকাশ অনুষ্ঠান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি এই অনুষ্ঠানে নীলার মা বক্তব্য দেওয়ার পর তাদের কে নিয়ে ক্রাবের সংবাদ সম্মেলনে আসবো। তিনি আমার কথায় ক্ষুব্ধ হলেন এবং ৫ মিনিটের মধ্যেই যেতে বললেন।
আমি ৬-৭ মিনিট পর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হলাম। নীলার মা দুই জায়গায় আবেগঘন কণ্ঠে বক্তব্য রাখেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে আমরা আবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সংহতি প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলাম। সেখানে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ডক্টর কামাল হোসেন সহ সবাই আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে সরকারের কাছে দাবি জানালেন।
অনুষ্ঠান শেষে আমি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে কথা বললাম লিঁয়াজোর বিষয়ে। তিনি বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মেসেজ পাঠানো হয়েছে ঐ উপদেষ্টার মাধ্যমে। তিনি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন।এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে নি। তবে ভালো এবং খারাপ যা ই আসুক না কেন, আমি তোমাকে জানাবো। আমি বললাম,ঠিক আছে।
আমি বললাম আমি আন্দোলনের মাঠে লেগে আছি। তিনি বললেন, "তুমি একটু সতর্ক থাকো। তুমি আটক হয়ে গেলে মাঠে কে থাকবে"?
আমি কিছুটা আশাবাদী হলাম। কারণ যেভাবে মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে সবাই মিলে আমাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে,তাতে সমঝোতা না হলেও আইনী লড়াই অথবা রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের মুক্তির ফায়সালা করা সম্ভব।
আমার বাড়ি কক্সবাজার। আমি একসময় এক বছরের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আন্দোলনের জন্য চট্টগ্রাম কে প্রস্তুত করা দরকার। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের সহযোদ্ধারা গা ঢাকা দিয়েছে। তদুপরি তারা চট্টগ্রাম মহানগরের সহযোদ্ধাদের সাথে নানা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। তাই আমি চট্টগ্রামের সহযোদ্ধাদের সাথে দ্বন্দ্ব নিরসন ও চট্টগ্রামে নেতাকর্মীদের মুক্তির জন্য ১৭ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম শহরে চলে গেলাম। সারারাত ট্রেনে জার্নি শেষে সকালে চট্টগ্রামে পৌঁছে কিছুটা রেস্ট নিয়ে জিইসি মোড়ে সহযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হলাম। ঐদিন চট্টগ্রাম মহানগরের সহযোদ্ধা আমির জুয়েল , আবদুল কাইয়ুম সহ চারজন এসেছিল। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোদ্ধাদের সাথে কথা বলেছি। সারাদিন ক্লান্তি শেষে ১৮ আগস্ট রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত এগারোটায় হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি ঐ সময় একটু ঘুম ভাঙলেই মোবাইল চেক করতাম। কারণ আন্দোলনের দুর্দিনে ভূমিকা পালন করার কারণে কেউ নেই কেউ আমাকে কল দিতো।
ঘুম থেকে উঠে মোবাইল সেট হাতে নিতেই দেখি মানবাধিকার নেতা নুর খান লিটনের মোবাইল নাম্বার থেকে কল এসেছে। আমি এতো রাতেও তার কল ব্যাক করলাম। কারণ প্রয়োজন ছাড়া অথবা বিপদে না পড়লে কেউই আমাকে কল দেয় না। তিনি কল রিসিভ করার সাথে সাথেই ঐদিন আমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার বিষয়টি ব্যাখা করলাম এবং তিনি কল দেওয়ার কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন যে,আপনি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী কে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনি সেটা পালন করেছেন এবং আগামীকাল আপনাকে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উনার সাথে অফিসে দেখা করতে বলেছেন। আমি চিন্তা করলাম এতে রাতে কি করা যায়? আমাদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের দুর্দিনে রাজপথে থাকা কয়েকজন সহযোদ্ধাদের নিয়ে একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ আছে। আমি সেখানে বললাম আমি সাংগঠনিক কাজে এবং আটক নেতাকর্মীদের খোঁজ খবর নিতে চট্টগ্রাম এসেছি।
এখানে আরো কিছু কাজ বাকি আছে।এই কাজ শেষ করে আমি গ্রামের বাড়িতে ঈদুল আজহা উদযাপন করতে যাবো। তাই আমি ঢাকায় যেতে পারছি না। আগামীকাল সকালে কারাবন্দী সহযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অফিসে যেতে হবে।কে যেতে পারবে? গ্রুপে কয়েক জন মেসেজ সিন করেছে।
কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। সাইফুল ইসলাম নামে এক ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক কর্মী ছিলেন। তিনি আমাদের সাথে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তিনি বললেন, আমি যাবো। আমি তাকে হোয়াটসঅ্যাপে বিস্তারিত বললাম। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আতা ভাই বললেন যে আমিও যাবো। তারপর তাকেও ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে পাঠানো হয়। আতা ভাই এবং সাইফুল ইসলাম
১৯ আগস্ট তাদের কে নিয়ে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অফিসে গেলেন।ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাদের কে নিয়ে আইনজীবীর চেম্বারে গেলেন।
তখন পর্দার অন্তরালে জামিনের সবকিছুতেই ক্লিয়ার। শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ফাইল পুট আপ বাকি। ২০ আগস্ট ফাইল পুট আপ করে জামিন চাইলে আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। পরের দিন ২১ আগস্ট নেতা-কর্মীরা কেরাণীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পায় । মহান আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করলাম।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের যেসব নেতাকর্মী বিএনপিপন্থী বলে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে এড়িয়ে যেতেন, তারাই পরবর্তী সময়ে ডাক্তারের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়েছেন।
ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারের সাথে দফায় দফায় বৈঠক শেষে জামিন নিশ্চিত করেছিলেন। আদালতের মাধ্যমে জামিন ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ঢাকা শহর, টাকার শহর। ঢাকা শহর, স্বার্থপর মানুষের শহর। এই দূষিত নগরীতে আমি এক বিশুদ্ধ এবং নিঃস্বার্থ মানুষের দেখা পেয়েছিলাম তার নাম ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ‘কাগমারী সম্মেলন’ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এটাই ছিল তার সাথে খবরের মাঠে ময়দানে সর্বশেষ দেখা।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারী (২০২৩) শনিবার দুপুরে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গেরিলা কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দার বীর উত্তম মিলনায়তনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারা-শহীদ, উদ্যোক্তা ও লেখক মুশতাক আহমেদের ২য় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক নাগরিক স্মরণসভায় নিউজ কভার করতে গিয়েছিলাম। অসুস্থ থাকায় জাফরুল্লাহ চৌধুরী অংশগ্রহণ করতে পারে নি। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে হাসপাতালের বিছানায় সৌজন্য সাক্ষাৎ করলাম। এরপর মাঝখানে আরো ১/২ বার তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের তথ্য উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু ভাইয়ের মাধ্যমে বড় ভাই ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিকিৎসার আপডেট জানতে পারতাম।
গত ১১ এপ্রিল রাত এগারোটায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।
গত ২৮ এপ্রিল শুক্রবার বিকেলে তার স্মরণসভায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস এবং সংবিধান রচয়িতা ডক্টর কামাল হোসেন সহ দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এতেই বোঝা যায় যে,ডাক্টার জাফরুল্লাহ চৌধুরী কত উচু মাপের মানুষ ছিলেন।জীবিত ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমরা মূল্যায়ন করি নাই। বর্তমান সরকার তার বিরুদ্ধে মাছ চুরি সহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দিয়ে তাকে অপমান করেছে।দুনিয়ার মানুষের ভালোবাসা নিয়ে কবরে ভালো থাকবেন বড় ভাই।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের বড় ভাই ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী কে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক। আমিন।
পুনশ্চ: ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা যাওয়ার দিন আমি এতেকাফে ঢুকে গিয়েছিলাম। তাই কলামটি লিখতে পারি নাই। পবিত্র রমজান মাসের ছুটি শেষে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্মরণে কলামটি লিখলাম।
লেখক: যুগ্ম আহ্বায়ক;বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, ছাত্র ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গণমাধ্যম কর্মী।