রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা বলতে সাধারণত আমরা কোনো রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখা ও সার্বভৌমত্বকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে নিরাপদ রাখাকে বুঝি। পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করলে প্রতীয়মান হবে যে বিষয়টি আসলে পুরোপুরিভাবে এমন নয়। এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কোনো দেশে জনগণের মুক্তি সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য যদি বাস্তবায়ন না হয় তবে সেটাও হতে পারে অর্জিত স্বাধীনতার মূলে কুঠারাঘাত সমতুল্য। কোনো রাষ্ট্র স্বাধীন ও সার্বভৌম এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, রাষ্ট্রটি সব রকমের বিদেশী আগ্রাসন ও প্রভাব বলয় থেকে পুরোপুরি মুক্ত এবং সেখানে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত আছে জনগণের সরকার। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দেশের শাসনতন্ত্র তৈরি করে এবং প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে যেখানে রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে। অর্থাৎ আপামর জনতাই সরকারের সব ক্ষমতার উৎস। রাষ্ট্র পরিচালনায় সেখানে পদে পদে পরিলক্ষিত হয় জনগণের নিকট নির্বাচিত সরকারের পূর্ণ জবাবদিহিতা। মূলত গণতান্ত্রিক ভাবধারার এমন একটি পরিবেশই কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপহার দিতে পারে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বাস্তব অবয়ব যেখানে রাষ্ট্রের সব স্তরের জনতা আস্বাদন করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রকৃত স্বাদ। এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে জনগণ অর্জিত স্বাধীনতার ফসল কখনই ঘরে তুলতে পারে না।
অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করে, যা ব্যতীত কারো পক্ষে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। রাজনৈতিক মুক্তির বিষয়টি বিকশিত গণতান্ত্রিক পরিবেশে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়। জনগণ অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে তাদের ন্যায্য ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। অর্থাৎ সাধারণ জনতাই সরকারকে নির্বাচিত করবে। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ হবে সরকারের সব শক্তির আঁধার। অন্যদিকে রাজনীতির ময়দানে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে থাকবে প্রজা হিতৈষী গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের সুস্থ প্রতিযোগিতা। সেখানে বিরাজ করবে না কোনো ধরনের অস্বাভাবিক কার্যকলাপ যা জনস্বার্থকে বিঘ্নিত করতে পারে। প্রতিপক্ষের প্রতি থাকবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি ও সহনশীলতার স্বভাব-সুলভ অনুশীলন। মূলত এটাই গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার যার পথ ধরে স্বাধীনতা সূর্য উদয়ের বার্তা জনগণকে দেয় হাতছানি। অন্যথায় স্বাধীনতা নামক সোনার হরিণটি আমজনতার নাগালের বাইরেই রয়ে যায়। রাষ্ট্রের জনগণ স্বাধীনতার ছদ্মাবরণে পরাধীনতার শিকলেই বন্দি থেকে যায়, যেখানে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা চরমভাবে উপেক্ষিত হয়, লঙ্ঘিত হয় মানবাধিকার।
ফলে সরকার এক সময় হয়ে পড়ে গণবিচ্ছিন্ন ও পররাষ্ট্রনির্ভর। এ সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এগিয়ে আসে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে। বিশ্ব মোড়ল ও তাদের সহযোগী আঞ্চলিক সুপার পাওয়ারগুলো বন্ধুত্বের ছদ্মাবরণে অগ্রসর হয় অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে। এমনকি সেটা হতে পারে কোনো রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণের মতো হীন চক্রান্ত পর্যন্ত।
বাংলাদেশে সম্প্রতি সংঘটিত ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব এবং দেশব্যাপী উদ্ভূত জনরোষের মুখে বিনা ভোটে নির্বাচিত একজন ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধানের স্বদেশ ভূমি ছেড়ে অন্য দেশে পলায়ন ছিল এর জলজ্যান্ত এক উদাহরণ। কণ্ঠ চেপে ধরলে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কীভাবে আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় উদগীরিত হয় তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ গত ৫ আগস্ট, ২০২৪। বাংলাদেশের ইতিহাসে দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে সৃষ্ট স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লবের এক মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে।
অন্যদিকে ইতিহাস থেকে এমনও পরিলক্ষিত হয় যে রাজ্যে প্রজা হিতৈষী ও গণতন্ত্রমনা প্রশাসন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় ক্ষমতালোভী ও উচ্চাভিলাষী কিছু গোষ্ঠী। কখনো কখনো বিদেশীদের সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে পরোক্ষ উপনিবেশবাদকে পর্যন্ত স্বাগত জানায় স্বদেশী মীরজাফর গং শুধু ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতার লোভ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। ক্ষমতা না পাওয়ায় প্রতিহিংসার অনলে জ্বলে-পুড়ে মারমুখী হয়ে ওঠে ঘসেটি বেগমরা। এ সুযোগে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ে ঠাণ্ডা মাথার নিরামিষভোজী রাজ বল্লভ, উমি চাঁদ ও জগৎ শেঠরা শুধু হিংসা-বিদ্বেষ প্রসূত মনোবাসনা পূরণে। সাময়িকভাবে তাদের চাওয়া-পাওয়া বাস্তবায়ন হলেও এক সময় এ বিশ্বাসঘাতকরা নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। ঘসেটি বেগমদের ঘটে সলিল সমাধি যেমনটি হয়েছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে যুদ্ধ নামক প্রহসনে নবাব বাহিনীর সাজানো পরাজয়ের পর।
যুগে যুগে এভাবে কখনো বিভিন্ন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আবার কখনোবা রাজনৈতিক নেতাদের ভুল সিদ্ধান্ত বা মতানৈক্যের কারণে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য বারবার অস্তমিত হয় যার চড়া মাশুল গুনতে হয় গোটা প্রদেশ বা রাষ্ট্রের জনগণকে।
এদেশে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থান যা ওয়ান ইলেভেন নামে খ্যাত, অনেকটা এমন পটভূমিতেই সংঘটিত হয়েছিল। এ ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল তথাকথিত নির্বাচিত এবং অগণতান্ত্রিক সরকার যেটি জাতির মাথার ওপর জগদ্দল পাথরের ন্যায় সুদীর্ঘ ১৫ বছর চেপে বসেছিল। কাঙ্ক্ষিত সব চাওয়া-পাওয়া আদায় করে নিয়েছিল তাদের বিদেশী প্রভূরা এবং দেশীয় কুশীলবরা। অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নয়নের ছদ্মাবরণে দুর্নীতির মহোৎসবের মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল দেউলিয়াপনার দিকে। শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী ছাত্র-জনতার সমন্বিত আন্দোলন থেকে সৃষ্ট স্বতঃস্ফূর্ত এক গণঅভ্যুত্থান ফ্যাসিজমের কালো থাবা থেকে আমাদের মুক্তি দেয়।
বর্তমানে মিয়ানমারের স্বাধীনতাকামী রাখাইন সম্প্রদায় কর্তৃক স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চলমান যুদ্ধ সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত মানবিক করিডোর সুবিধাও দেশে আবার নতুন করে কোনো সামরিক অভ্যুত্থান, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগ কিংবা বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক বিশ্ব মোড়ল ও তাদের সহযোগী বা প্রতিপক্ষ হিসাবে পরিচিত একাধিক আঞ্চলিক পরাশক্তির মদদে উদ্ভূত বহুমাত্রিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতাকে উসকে দিতে পারে, যার বলির শিকার হবে দেশের কোটি কোটি জনগণ। লুণ্ঠিত হবে তেল-গ্যাসসহ দেশের সব প্রাকৃতিক সম্পদ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা যেভাবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগে-পরে বন্ধু দেশ কর্তৃক লুটপাটের শিকার হয়েছিল রাষ্ট্রীয় সম্পদের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প কারখানা ও বিপণি বিতানগুলো যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রাজবন্দি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন বরিশালের কৃতী সন্তান মেজর (অব.) এম এ জলিল। এভাবে রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়ন চলমান থাকলে এক সময় দেশ অগ্রসর হবে দেউলিয়াপনা ও অকার্যকর রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে। সুযোগটিকে ব্যাটে-বলে কাজে লাগিয়ে দেশীয় কুশীলবদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় বিদেশী শকুনদের কালো থাবা এক সময় দেশের মানচিত্রকে করে দিতে পারে খণ্ড-বিখণ্ড। তাই যেকোনো জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা সংকট সমাধানের প্রাক্কালে দেশের সরকার ও প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এক টেবিলে বসার কোনো বিকল্প নেই। কারণ রাজনৈতিক নেতাদের সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়েই সরকার পেতে পারে সঠিক দিক-নির্দেশনা, যেখানে রাষ্ট্রের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের পাশাপাশি অতীতের সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে জাতীয় স্বার্থকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয়া উচিত। অন্যথায় জাতীয় সংহতির ব্যত্যয় ঘটলে অপ্রত্যাশিত কোনো হুমকির হাতছানি দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে।
অন্যদিকে বর্তমান শাসক গোষ্ঠীকে অনুধাবন করতে হবে এত এত বিদেশী পুরস্কার, সম্মাননা ও লাল গালিচা সংবর্ধনার নেপথ্যে বিদেশী মোড়লদের কোনো সুপ্ত বাসনা লুকায়িত আছে কিনা। সেটা বুঝতে ব্যর্থ হলে দেশ আবার নতুন করে হতে পারে বিশ্ব মোড়ল কিংবা পুরনো বা নব্য কোনো আঞ্চলিক পরাশক্তির করদ রাজ্য। বাংলাদেশ পরিণত হতে পারে গাজার ন্যায় আগুনে পোড়া নতুন কোনো ভূখণ্ডে।
অতএব, জাতীয় রাজনৈতিক নেতাদের দেশপ্রেম ও দূরদর্শিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা, গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের অনুশীলন ও লালন এবং দেশের জনগণের সর্বাত্মক সংহতিই হতে পারে আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মূল রক্ষাকবচ। ইতিহাসের কঠিন বাস্তবতা আমাদের এ শিক্ষাই দেয়।
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার বার্তা/এরশাদ হালিম/সিআর/এমই