অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছি। মাঝপথেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হলো। লন্ডনে যে কখন বৃষ্টি হবে, তা বোঝা মুশকিল। অন্য সব জায়গার মতো এখানকার বৃষ্টি ঋতুর অপেক্ষায় থাকে না, অযাচিত মেহমানের মতো নিমন্ত্রণ ছাড়াই চলে আসে। তাই সাথে সবসময় একটা ছাতা রাখি। স্ট্রাটফোর্ড স্টেশনে পৌঁছানোর পর মনে পড়লো, স্ট্রাইকের জন্য সব টিউবস্টেশন বন্ধ আজ। এই ব্রেক্সিটের পর থেকে যে হারে স্ট্রাইক হচ্ছে, তা সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে ২৫ নাম্বার বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন লাল বাসটির দেখা মিললো, তখন এক স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেললাম। কিন্তু সেই স্বস্তিতে জল ঢেলে বো রোডেই নামিয়ে দিলো বাসটি। বৃষ্টি থেমে এতক্ষণে শুরু হয়েছে তুষারপাত। আমার বাসায় পৌঁছতে এখনো অনেক পথ বাকি। সেখানে দাঁড়িয়ে আরেকটা বাসের জন্য অপেক্ষা করেও যখন কোনো বাসের দেখা পেলাম না, তখন অলগেটের উদ্দেশ্যে ওভারকোটের কলারটা তুলে হাঁটা শুরু করলাম। তুষারপাতের এই জনহীন রাতে মনে হলো, কেউ যেন আমার পিছু নিচ্ছে। একটু দ্রুত হাঁটার পর সামনে দু’একটা লোকের দেখা মিললেও মন থেকে ভয়টাকে তাড়াতে পারলাম না। পেছনে ফিরে কয়েকবার দেখলামও কেউ আছে কিনা। কিন্তু তীব্র তুষারপাতের জন্য কোনো পায়ের ছাপও বোঝা যাচ্ছে না।
শুধু আজ নয়, কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছে, কারা যেন আমার পিছু নেয়। আমি যেখানেই যাই, যা-ই করি না কেন, আমার ওপর কঠোর নজর রাখে কেউ। তাই আশপাশের সবাই যে চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকে, তা আমার জন্য একটু অস্বস্তির সূচনা ঘটায়। আশঙ্কা, মৃত্যু আশঙ্কা! ব্যস্ত এই শহরে কেউ-ই আমাকে চেনে না। তবুও কেউ আমাকে মারতে চায়। প্রশ্ন হলো, কেন?
বেশ কিছুদিন হলো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যাচ্ছি। আমি যথেষ্ট চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। লন্ডনে আসার পর তাই তেমন কোনো বন্ধুও বানাতে পারিনি। প্রায় ১৮ বছর হয়ে যাচ্ছে লন্ডনে এসেছি। আমার শুধু একটি মাত্র বন্ধুই আছে। নাম ফারহান, সে এখন বড় মাপের ডাক্তার। আমি চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় সে-ই এসে আমার সাথে বন্ধুত্ব পাতায়। আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই, এটা যেমন সত্য, তেমনি আমার কোনো শত্রু নেই, এটাও আমি সত্য মনে করি। কথায় আছে না, ‘বোবার শত্রু নেই’। আমি এটাই বিশ্বাস করি। আরেকজন আছে, যে আমার অনেক কাছের মানুষ। সে হলো আমার ওয়াইফ। আমার বন্ধুই আমার জন্য এই সম্বন্ধটি নিয়ে এসেছিল।
তবে কি ওরাই আমাকে মারতে চায়? প্রায় মাসখানেক হলো প্রাচীর ওপর আমার সন্দেহ হচ্ছে। ওদের দু’জনের ব্যবহার আমাকে ভাবাচ্ছে, ওরা কি আসলে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে! ফারহান প্রায় দিনই আমার অনুপস্থিতিতে বাসায় আসে। আমি বাসায় ঢুকলেই কেমন করে যেন আমার দিকে তাকায়।
বেশ অস্বাভাবিক আচরণ করে আজকাল। ওরা দু’জনই মনে হয় তাহলে আমাকে মেরে একসাথে নতুন সংসার শুরু করতে চায়। ওরা ছাড়া তো আর কারো কাছে আমাকে মারার কোনো মোটিভ নেই। হাঁটতে হাঁটতেই বাসায় পৌঁছে গেছি। এখন তো আরো ভয় করছে। আমার মৃত্যুশঙ্কা যদি সত্য হয়, তাহলে নিজেকে বাঁচাতে কী করতে পারি আমি? বাসায় ঢুকতেই দেখলাম, ফারহান ও প্রাচী সোফায়। তারা আমাকে দেখে কেমন যেন নড়েচড়ে বসলো। ফারহান তাড়াহুড়া করে কী যেন ব্যাগে ঢুকালো।
আমাকে বিভ্রান্ত করতে প্রাচীও আমার কাছে এসে আমার ওভারকোটটা খুলে হাতে নিলো। আমি যে ওদের আমাকে মারার উদ্দেশ্য বুঝে গিয়েছি, তা ওদের বুঝতে দিলাম না। বেশ কষ্টেই স্বভাবিক আচরণ করতে লাগলাম। সোফায় বসে এদিক-সেদিকের কথা বলতে শুরু করলাম ফারহানের সাথে। প্রাচী কফি আনতে গিয়েছে আমাদের জন্য। কিছুক্ষণ পর কিচেনের দিকে চোখ পড়তেই দেখি, আমার কফির কাপে প্রাচী কিছু একটা মেশাচ্ছে। আজকেই কি তারা আমাকে মেরে ফেলবে? আমি ভয়ে ভয়ে ফারহানের ব্যাগের দিকে তাকালাম। ওখানে অনেকগুলো ইঞ্জেকশন ও গ্লাভস দেখতে পেলাম। আমার আর বোঝার বাকি রইলো না, কী হতে যাচ্ছে আমার সাথে। আমি কাপড় বদলানোর বাহানায় রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
নাহ! আমি এত জলদি মরতে চাই না। কিভাবে বাঁচাবো নিজেকে? গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার। ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে না। আমাকে কিছু-একটা উপায় বের করতেই হবে। এই আতঙ্কের ঘোর কাটতেই চোখ পড়লো খাটের পাশে পড়ে থাকা ইন্সুলিনের দিকে। বাঁচার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষাই বোধ হয় বাঁচিয়ে রাখার এই যন্ত্রকে মারণাস্ত্র হিসেবে ভাবতে শেখালো। ওরা আমাকে মারার আগেই একে একে ওদের দু’জনকে মেরে ফেলতে হবে।
প্রাচীকে ডাকলাম খুব স্বাভাবিকভাবেই। ও রুমে আসতেই বললাম দরজাটা আটকিয়ে আমার পাশে এসে বসতে। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর গলা চেপে ধরে জিহ্বার নিচে ইন্সুলিনটা দিলাম। এমন সময় সে বাঁচার জন্য হাত-পা নাড়াতে নাড়াতে আশপাশের সব জিনিস ফেলে দিয়েছে। শব্দ শুনে ছুটে এলো ফারহান। ফারহান রুমে ঢুকতেই হাতাহাতি শুরু হলো আমাদের। এক পর্যায়ে ফারহান আমাকে ধাক্কা দিয়ে সোফার কাছে ফেলে দেয়।
পাশে থাকা ফারহানের ব্যাগ থেকে খালি ইঞ্জেকশন নিয়ে তার গলায় বাতাস ইঞ্জেক্ট করে দিলাম। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে, ফারহান ৯৯৯-এ কল দিয়ে দিয়েছে। কী বলবো, বুঝতে না পেরে আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললাম, আত্মরক্ষার প্রচেষ্টাতেই আমি দুজনকে মেরে ফেলেছি। ফোনের ওপাশ থেকেও খুব ভয়ংকর গলায় বলে উঠলো, আপনি ওখানেই থাকুন। কোথাও যাবেন না।
তাদের কথা শুনে মনে হলো, দুইটি খুনের অপরাধে আমাকেই তারা দোষী করবে। কেউ আমাকে বাঁচতে দেবে না। পুলিশ এলো। তারা বললো, ক্রাইম সিন দেখে নাকি মনে হচ্ছে না, আমি আত্মরক্ষা করতে গিয়ে খুন করেছি। তাদেরকে আমি বললাম আমার কফির কাপের কথা। সেখানে বিষ মিশিয়েছে প্রাচী। আমার কথা যাচাই করতে তারা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠালো কফির কাপটি। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হলো থানায়। ফরেন্সিক রিপোর্টও এসে গেছে। তবে কফিতে বিষের বদলে পাওয়া গেলো ক্লোরপ্রোেমাজিন, যা পার্সিকিউটরি ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডারের ওষুধ। তাহলে কি সেই কল্পিত মুহূর্তের কারাগারই আমাকে বন্দি করে নিলো এই ভয়ের রাজ্যে!
লেখক: লন্ডন সিটি ইউনির্ভাসিটিতে আইন বিষয়ে অধ্যায়নরত।
আমার বার্তা/সাম্মাম জুনাইদ ইফতি/এমই