ই-পেপার শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

ভূমিকম্পের হুমকিতে বাংলাদেশ

মো. ইশতিয়াক হোসেন রাতুল:
২৯ মার্চ ২০২৫, ১০:৪৯

একটি প্রচণ্ড ভূমিকম্প যখন আঘাত হানে, তখন পুরো পৃথিবী যেন কাঁপতে থাকে, যেন ধ্বংসের সাইরেন বেজে ওঠে চারদিকে। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়—মাটির নিচ থেকে উঠে আসে ভয়ঙ্কর গর্জন, বিশাল ভবনগুলো দুলতে থাকে মৃত্যুর প্রহর গুনে। আতঙ্কিত মানুষগুলো চিৎকার করে দৌড়াতে থাকে, কিন্তু কোথাও নিরাপদ আশ্রয় নেই। রাস্তাগুলো ফেটে যায়, ভবনগুলো একে একে ধসে পড়ে, যেন বিশাল কোনো দৈত্য ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে শহরের ওপর। বিদ্যুৎ চলে যায়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আর ধুলো আর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে অসংখ্য মানুষ, তাদের কান্নার শব্দও ক্রমশ মৃদু হয়ে আসে। চোখের সামনে প্রিয়জনদের হারানোর এই বিভীষিকা যে একবার দেখেছে, সে জানে—ভূমিকম্প শুধু মাটিকেই নয়, মানুষের আত্মাকেও চিরতরে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়!

ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে এমন একটি স্থানে অবস্থিত, যা পৃথিবীর এক অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে - ইন্ডিয়ান প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট এবং বার্মা প্লেট। এই প্লেটগুলোর ক্রমাগত গতির ফলে দেশটি ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইন্ডিয়ান প্লেট প্রতি বছর প্রায় ৪৬ মিলিমিটার হারে উত্তরের দিকে সরে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অস্থিরতা বৃদ্ধি করছে এবং এই অস্থিরতার ফলে হিমালয়ান বেল্টে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে ভূমিকম্প আকারে শক্তি মুক্তির মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যার মধ্যে কিছু ছিল মাঝারি মাত্রার, আর কিছু ছিল মৃদু। ২০২৫ সালের ২৪ জানুয়ারির রাতে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে, প্রায় ৪৮৯ কিলোমিটার দূরে। এই ভূমিকম্পে কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। এরপর, ৫ মার্চ ২০২৫ সালে, বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে আবারও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায়, তবে এর মাত্রা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি।

২০২৪ সালেও বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। ১৮ অক্টোবর, রাত ১২টা ৪৩ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ৪.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণে, মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। ৬ সেপ্টেম্বর, রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রংপুর অঞ্চলে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভুটানে। একই বছরের ২ জুন, মিয়ানমারে ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে, যা বাংলাদেশের রাঙামাটিতেও অনুভূত হয়।

এছাড়া, ২৮ এপ্রিল রাত ৮টা ৫ মিনিটে রাজশাহী অঞ্চলে ৪.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের উত্তমপুর। ২০ এপ্রিল, চট্টগ্রামে ৩.৭ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যা ভারত সীমান্ত থেকে ৩৪ কিলোমিটার এবং মিয়ানমার থেকে ৬৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। ১৪ ফেব্রুয়ারি, রাত ৮টা ৭ মিনিটে চুয়াডাঙ্গায় ৩.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল পাবনার আটঘরিয়া।

এই ভূমিকম্পগুলোর বেশিরভাগই উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি করেনি, তবে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। তাই, ভূমিকম্প-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, পূর্ব সতর্কতা গ্রহণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ইতিহাস দীর্ঘ এবং ভয়াবহ। ১৮৯৭ সালে ৮.৭ মাত্রার গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে সিলেট ও আসাম অঞ্চলসহ সমগ্র পূর্ব ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছিল। ১৯১৮ সালে ৭.৬ মাত্রার শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প এবং ১৯৫০ সালের ৮.৬ মাত্রার আসাম ভূমিকম্পও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে, ২০১৫ সালে নেপালে সংঘটিত ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুভূত হয়েছিল, যদিও তা থেকে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি।

ঢাকা মহানগরীর ভূমিকম্প ঝুঁকি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অত্যধিক জনঘনত্ব এবং নির্মাণের দুর্বলতা ঢাকা শহরকে ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় শীর্ষে স্থান দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ঢাকার ৯০ শতাংশের বেশি ভবন ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরের প্রায় ৭২ হাজার ভবন মাত্র ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্পেই ধসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভবন নির্মাণে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) অনুসরণ না করা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী এবং ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার এই ঝুঁকিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে।

বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে ভূমিকম্প নীতিমালা প্রণয়ন করলেও এর বাস্তবায়ন এখনও সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রেডি প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলেও, তা দেশের প্রয়োজনীয়তার তুলনায় অত্যন্ত কম। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সক্ষমতা এখনও যথেষ্ট নয়। ঢাকা মহানগরীতে মাত্র ৩৩টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে, যা এই বিশাল জনগণের জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত। ভারী উদ্ধার যন্ত্রপাতির অভাব, জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং পেশাদার উদ্ধারকর্মীর স্বল্পতা উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।

ভূমিকম্প ঝুঁকি প্রশমনের জন্য তিনটি স্তরে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:১/তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ:সরকারি ও বেসরকারি ভবনে BNBC কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।ঢাকা শহরের জন্য জরুরি উদ্ধার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ আবশ্যক।২/মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ:মাসিক ভূমিকম্প ড্রিল বাধ্যতামূলক করতে হবে।পুরানো ভবনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে এবং অবকাঠামোগত আধুনিকায়ন করতে হবে।ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নির্মাণে প্রণোদনা এবং কর রেয়াত প্রদান করা প্রয়োজন।৩/দীর্ঘমেয়াদি কৌশল:ভূমিকম্প পূর্বাভাস ব্যবস্থা স্থাপন জরুরি।নগর পরিকল্পনায় ভূমিকম্প ঝুঁকিকে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো।

এছাড়া, জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ নাগরিক ভূমিকম্পকালীন করণীয় সম্পর্কে অজ্ঞাত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভূমিকম্প ড্রিলের ব্যবস্থা না থাকা, মিডিয়ায় সচেতনতামূলক প্রচারণার অভাব এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণের অভাব এক বড় সমস্যা। এই অবস্থা পরিবর্তন করতে হলে গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। টেলিভিশন এবং রেডিওতে নিয়মিত সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার, স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প ড্রিল বাধ্যতামূলক করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন জরুরি।

বাংলাদেশ এখনো বড় ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭+ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হলে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন ধ্বংসযজ্ঞকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে এখনই সমন্বিত প্রচেষ্টা শুরু করা প্রয়োজন। ভূমিকম্প নয়, অপ্রস্তুতিই মূলত ধ্বংস ডেকে আনে। এই কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করে আমাদেরকে এখনই সক্রিয় হতে হবে, নতুবা ইতিহাস আমাদেরকে কঠোরভাবে বিচার করবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আমার বার্তা/মো. ইশতিয়াক হোসেন রাতুল/এমই

বাবা, তুমি আমার নীরব ভালোবাসা

আমার বাবাকে আমি অনেক ভালোবাসি। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলতে পারিনি— “বাবা, আমি তোমাকে অনেক

বিশ্ব বাবা দিবস : বাবা হচ্ছে সংসারের একজন বটবৃক্ষ

বিশ্বের প্রায় দেশেই জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালন করে আসছে। সে হিসেবে এবছর

এফবিসিসিআইয়ের সংস্কার উত্তর  নির্বাচন ও কিছু কথা

গত ২০ মে ২০২৫  তারিখে ব‍্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে বর্তমান গণ অভ‍্যুত্থানের মাধ‍্যমে গঠিত সরকার

অর্থবছর পরিবর্তন করতে হবে

প্রথমে বলতে চাই- অর্থবছর পরিবর্তন করতে হবে। আমরা জানি, ব্রিটিশ আমল থেকে অর্থবছর জুলাই-জুন হিসেবেই
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চেলসিকে ধরাশায়ী করলো আরেক ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লামেঙ্গো

জেনে নিন শনিবার দিনটি কেমন কাটবে

ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে তুরস্কে পৌঁছেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

শাবিপ্রবিতে সহপাঠীকে অজ্ঞান করে পালাক্রমে ধর্ষণ, ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল

ত্রিপক্ষীয় নতুন জোটে বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক

ময়মনসিংহে দুই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১১

নতুনবাজারে ইউআইইউ শিক্ষার্থীদের অবরোধে যান চলাচল বন্ধ 

ইরানের পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে গোয়েন্দা তথ্য ভুল ছিল: ট্রাম্প

গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে ছাত্র জনতার অবদান অপরিসীম: ফখরুল

২১ জুন ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা

কালুখালীতে প্রেমিকের বাড়িতে বিয়ের দাবিতে তরুণীর অবস্থান, মারধরের অভিযোগ

ময়মনসিংহে বাসের ধাক্কায় নিহত ৬, বাসে আগুন

নির্ভুল মানচিত্রায়নের মাধ্যমে টেকসই সমুদ্রনীতি গড়ে তুলতে হবে

সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ইকবাল বাহার আটক

একসঙ্গে ২৫টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান : ইসরায়েল

লোহাগাড়ায় অস্ত্রসহ আন্তঃজেলা ডাকাত চক্রের ৪ সদস্য গ্রেফতার

অতি ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ের পূর্বাভাস, বন্দরে ৩ নম্বর সতর্কতা

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ১৫১ জন হাসপাতালে

আইআরজিসির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন খামেনি

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ