ই-পেপার সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২

ঢাকার ফুটপাথ পথশিশুদের ঘর ও আশ্রয়স্থল

জামিল হোসেন
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:১৪
আপডেট  : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৫০

ঢাকার মতো একটি শহর যেখানে উন্নয়ন ও প্রগতির ছোঁয়া অথচ সেই শহরের ফুটপাথগুলোতে লুকিয়ে আছে এক করুণ বাস্তবতা। এই ফুটপাথগুলোই অনেক পথশিশুর জন্য ঘর, আশ্রয়স্থল এবং জীবনের প্রতিদিনের লড়াইয়ের মঞ্চ। তারা রাস্তায় বাস করে, রাস্তায় খায়, রাস্তায় ঘুমায় এবং রাস্তায় বড় হয়। কিন্তু এই কঠিন জীবনযাত্রার পেছনে লুকিয়ে আছে তাদের অকথ্য মানসিক স্বাস্থ্য সংকট, যা বেশিরভাগ সময় উপেক্ষিত থেকে যায়।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস

বেশিরভাগ পথশিশুই জন্ম নিয়েছে দারিদ্র্যের কঠিন বাস্তবতায়। কেউ বাবা-মাকে হারিয়ে, কেউবা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে, আবার কেউ গ্রাম থেকে শহরে এসে হারিয়ে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছে ফুটপাথে। এদের কারও কারও পরিবার আছে, কিন্তু দারিদ্র্যের চাপে তারা বাধ্য হয় রাস্তায় জীবনযাপন করতে। সাধারণত সব শিশুই এ বয়সে পরিবারের অটুট বন্ধনে থেকে মা-বাবার নিবিড় পরিচর্যায় বেড়ে উঠে। কিন্তু নির্মম বাস্তবতার জন্য সবাই মা-বাবার ছায়ার নিচে সুন্দর একটি জীবন নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে না। যে বয়সে তাদের কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সে বয়সে তারা তাদের কাঁধে একটি ধুলোমাখা বস্তা ঝুলিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। যে বয়সে তাদের পরিবার আর বন্ধুদের সাথে আনন্দে সময় কাটানোর কথা, সে বয়সে তারা পথে পথে, খোলা আকাশের নিচে প্রতিনিয়ত বাঁচার লড়াই করে। তারা বেড়ে উঠে নানা অবহেলা আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে। এই বয়সে ওদের পরিচয় হয় পথশিশু হিসবে। অধিকাংশ পথশিশুদের নিজস্ব কোনো পরিবার নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারা পরিবার থেকে পালানো কিংবা মা-বাবা তাড়ানোও হয়। অনেকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সবটাই রাস্তায়। সাধারণত বিভিন্ন জনসমাগমপূর্ণ স্থান বিশেষ করে রেল স্টেশন, বাস স্টপেজ, লঞ্চ টার্মিনাল ইত্যাদি জায়গায় পথশিশুদের দেখা যায়। পথশিশুরা ঠিকমতো দু’বেলা পেট পুরে খেতে পারে না। কোনো সময় এক বেলা জুটলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে অভ্যস্ত এসব শিশুদেরকে ক্ষুধার তাড়নায় ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট খাবার কুড়িয়ে খেতেও দেখা যায়।

পরিবারের স্নেহবঞ্চিত এসব শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। খাবারের জন্য কুকুরের সঙ্গে লড়াই করা, ফুটপাথে ঘুমানো, আর বৃষ্টি হলে দোকানের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া। এসবই তাদের নিত্যদিনের ঘটনা।

পথশিশুদের জীবন : সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি

ঢাকার ফুটপাথগুলোতে বসবাসকারী পথশিশুদের জীবন প্রতিদিনের সংগ্রামের একটি প্রতিচ্ছবি। পথশিশুদের বেশিরভাগই সারাদিন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে। কেউ ফুল বিক্রি করে, কেউ গাড়ির কাচ পরিষ্কার করে, কেউবা ভিক্ষার আশ্রয় নেয়। কিছু শিশু ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁজে নেয়, কেউ কেউ ময়লা কুড়িয়ে বিক্রি করে সামান্য আয় করে। তারা পরিবার, শিক্ষা এবং নিরাপত্তার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের জীবনযাত্রা অস্থির, অনিশ্চিত এবং প্রায়ই সহিংসতার মুখোমুখি। অনেক পথশিশুই নানা ধরনের শোষণ, নির্যাতন এবং অবহেলার শিকার হয়। তাদের অনেকেই মাদকাসক্ত, পাচারের শিকার কিংবা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এই সবকিছুই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। শিক্ষার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।

ফার্মগেটের ফুটপাতে হোটেলের ফেলে দেওয়া খাবার খাচ্ছে দুই পথশিশু। দিনপ্রতি মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে তারা কাজ করে সিটি কর্পোরেশনের ময়লা শ্রমিকের বদলি হিসেবে। ছবি: সংগৃহীত।

পথশিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট : উপেক্ষিত সমস্যা

পথশিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট একটি গুরুতর সমস্যা, যা অনেক সময় উপেক্ষিত হয়। এতে করে তারা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। অনিরাপদ পানি পান করা, অপরিচ্ছন্ন খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে তারা নানা ধরনের মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশার মধ্যে বসবাস করে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক বৈষম্য, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করে। অপুষ্টি, চর্মরোগ, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, এমনকি টিবি ও অন্যান্য সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি।

এছাড়া, অনেক পথশিশুই বিষন্নতা, উদ্বেগজনিত সমস্যা, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এবং অন্যান্য মানসিক রোগে ভুগছে। কিন্তু তাদের এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, যা তাদের ভবিষ্যৎকে আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার অভাব

পথশিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তাদের জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট স্কুল, নেই কোনো বিনামূল্যের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা না থাকায় তারা ভবিষ্যতে কোনো ভালো কাজের সুযোগও পায় না, ফলে দারিদ্র্যের চক্রে আটকে পড়ে।

শুধু শিক্ষা নয়, স্বাস্থ্যসেবা থেকেও তারা বঞ্চিত। অসুস্থ হলে ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই, চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই। অপুষ্টি, চর্মরোগ, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, এমনকি যক্ষ্মার মতো রোগে আক্রান্ত হয় তারা। অপরিষ্কার পানি, অনিরাপদ খাদ্য, এবং অনিশ্চিত আশ্রয় তাদের স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।

পথশিশুদের সমস্যা সমাধানে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হতে পারে

সরকার ও সমাজের উচিত পথশিশুদের নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। তাদের জন্য নিরাপদ আবাসন, পুষ্টিকর খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। বেসরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদেরও এগিয়ে আসা উচিত। প্রথমত, তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সহজলভ্য করতে হবে এবং পথশিশুদের জন্য বিশেষায়িত কাউন্সেলিং ও থেরাপির ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে পথশিশুদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পথশিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পথশিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা

ঢাকার ফুটপাথগুলোতে বসবাসকারী পথশিশুদের জীবন কঠিন, কিন্তু তাদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলা করে তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যায়। সমাজ, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন এই সমস্যা সমাধানের জন্য। পথশিশুদের কেবল বেঁচে থাকার জন্য নয়, সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাদেরকে দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে সমাজের মূলধারার মূল্যবোধ তৈরিতে রাষ্ট্রকে প্রধান কাজ করতে হবে। তাদের হাসি ফোটানোই হবে আমাদের সত্যিকারের উন্নয়নের মাপকাঠি।

লেখক : জামিল হোসেন, অনলাইন নিউজ এডিটর, দৈনিক আমার বার্তা, ঢাকা।

আমার বার্তা/জেএইচ

শিক্ষা-শিল্প ফাঁক কমাতে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গত এক দশকে বিস্তারের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা

হাদির ওপর হামলা, শান্তির পথে কাঁটা ছড়াচ্ছে কারা?

বহু প্রতীক্ষা ছিল। নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছিল দেশ। নির্বাচন কমিশন ‘তফসিল’ ঘোষণা করল। নির্বাচনের ট্রেন

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব। তবে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান

এনটিআরসিএ নামকরণের সার্থকতা যথেষ্ট যৌক্তিক

NTRCA এর পূর্নাঙ্গ রূপ N= Non, T= Trusted, R= Researches and, C= Corrupted,  A= Authority.
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১৭ বছরে দেশের আইনশৃঙ্খলা-অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে দেওয়া হয়েছে: আসিফ নজরুল

আমাদের সবাইকে এখন ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে: তারেক রহমান

আহমদ ছফার নামে রাস্তার নামকরণ করলো ডিএনসিসি

আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে ১ গোল্ডসহ ১১ পদক জয় বাংলাদেশের

অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে ঝালকাঠির সাবেক মেয়র গ্রেপ্তার

হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে রিট

নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি: ইসি

হাদির হত্যাকারী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই: অতিরিক্ত আইজিপি

ভারতকে উড়িয়ে যুব এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান

ফেসবুকে লিংক শেয়ারকারীদের জন্য দুঃসংবাদ

তারেক রহমানের ফেরার দিনে মা‌র্কিন নাগ‌রিকদের জন্য দূতাবাসের বার্তা

বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে আগাম সতর্কতা জোরদারের আহ্বান বিএমডির

নির্বাচন ও গণভোট সামনে রেখে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু: ইসি

ই-রিটার্ন ব্যবস্থায় যুক্ত হবে ব্যাংকিং তথ্য: এনবিআর চেয়ারম্যান

রাবিতে পদত্যাগের দাবিতে আওয়ামীপন্থি ডিনদের কার্যালয়ে তালা

হামলাকারীদের পালাতে সহায়তাকারী সিবিয়ন-সঞ্জয় ফের ৫ দিনের রিমান্ডে

ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনের ঘোষণা দিলো আফগানিস্তান

সহিংসতা ও নৈরাজ্যে গভীর উদ্বেগ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের

‘বাংলাদেশি ভেবে’ কেরালায় দলিত শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা

ইবিতে ওসমান হাদি ও দীপু চন্দ্র দাশ হত্যার প্রতিবাদ পূজা উদযাপন পরিষদের