গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে উত্তেজনার পারদ চরমে উঠেছে। ২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে মাঠের মাঝেই বিখ্যাত নাগিন ডান্স দিতে শুরু করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। এছাড়া ২০২০ সালের এশিয়া কাপে বাংলাদেশকে হারিয়ে নাগিনের মত করে নাচের অঙ্গভঙ্গি দেখিয়েছিলেন লঙ্কান চামিকা করুণারত্নে। মাঠের ক্রিকেটে এসবের প্রভাব পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। ধীরে ধীরে তাই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের মত বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কাকেও রাইভাল হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন অনেকে। ২০২৩ সালের এশিয়া কাপের সম্মেলনে লঙ্কান অধিনায়ক দাসুন সানাকা বলেছিলেন, ‘হয়ত মাঠের বাইরে সমর্থকদের মধ্যে রাইভালরি আছে, মাঠে আমরা ক্রিকেটারদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বাইরে কী হচ্ছে তা তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমাদের মধ্যে দারুণ ভ্রাতৃত্ববোধ রয়েছে।’ কিন্তু মাঠের খেলা এলেই যেন সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছাপ ফুটে ওঠে মাঠে এবং দর্শকদের ভিতরে।
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরমেন্স তেমন সন্তোষজনক না হলেও বাংলাদেশ সাক্ষী দিয়েছে এক ইতিহাসের। এবং সেটিও তাদের সো কল্ড রাইভাল শ্রীলংকার বিপক্ষের ম্যাচেই।বাংলাদেশে বিশ্বকাপে নড়বড়ে অবস্থানে থাকলেও প্রতিপক্ষ শ্রীলংকার সাথে ২৮০ রান তারা করতে নেমে সহজেই, তিন উইকেট এবং ৫৩ বল বাকি থাকতে সহজ জয় তুলে নেয়। মাত্র সাত রানে সাকিবকে সাজঘরে ফেরানোর সুযোগ থাকলেও এঞ্জেলো ম্যাথিউস এর বলে শাকিবের ক্যাচ ফেলে দিয়ে ব্যাটিং ইনিংসের নায়ক আসালঙ্কা যেন হয়ে ওঠেন ফিল্ডিং এর খলনায়ক। এরপর সাকিবকে আর থামানো যায়নি। নাজমুল হোসেন শান্তর সাথে ১৬৯ রানের পার্টনারশিপ করে দলের জয় অনেকটা নিশ্চিত করে ফেলেন। এরপর এঞ্জেলো ম্যাথুস এর শিকার হয়ে দুইজনই সাজঘরে ফিরলে খেলাটা একটু রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে। তারপর ধীরে মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ, মেহেদী হাসান মিরাজ সাজঘরে ফিরে গেলে আতঙ্ক জাগে বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের মনে। অবশেষে তৌহিদ হৃদয় শেষ পর্যন্ত তানজিম সাকিবের সাথে জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়েন। ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ব্যাটিংয়ে ৬৫ বলে ৮২ রানের এক ঝলমলে ইনিংস খেলার পাশাপাশি বোলিংয়ে তার ঝুলিতে ছিল ৫৭ রান খরচ করে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট।
আজ ক্রিকেট বিশ্ব সাক্ষী হলো এক ভিন্ন ধরনের উইকেটের। ২০২৩ বিশ্বকাপের বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে অনুষ্ঠিত গ্রুপ পর্বের ৩৮ তম ম্যাচে বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের বলে ২৫ তম ওভারের দ্বিতীয় বলে আউট হন শ্রীলংকান ব্যাটসম্যান সামারাবিক্রমা। সাকিবের করা বলে সামারাবিক্রমার তুলে মারা শটটি তালু বন্দি করেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তারপর তাড়াহুড়ো করে মাঠে প্রবেশ করতে দেখা যায় অভিজ্ঞ ক্রিকেটার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস কে। এমনিতেই একটু দেরিতে মাঠে প্রবেশ করার পর বল সম্মুখীন করার আগেই তার হেলমেটে স্কাইপ খুলে যায় এবং সে পরিবর্তন করতে চান। তিনি বল সম্মুখীন করার আগেই অনেক সময় ক্ষেপণ হয়। এতে বিরক্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান আম্পায়ারের কাছে টাইম আউটের আবেদন করলে আম্পায়ার তার ডাকে সাড়া দেন এবং এঞ্জেলো ম্যাথিউস কে আউট ঘোষণা করেন। আম্পায়ার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি এঞ্জেলো ম্যাথিউস। তিনি বেশ কিছুক্ষণ ধরেই তার ব্যর্থ যুক্তি দাড় করানোর চেষ্টা করে যান। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কোন বল না খেলেই সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে। সাঝঘরে ঢোকার সময় বেশ ক্ষিপ্ত দেখা যায় তার আচরণ। হেলমেট ছুড়ে ফেলে দেন মাঠে। তারপর কুশল মেনডিস তার প্রাক্তন কোচ হাতুড়ি সিং এর সাথে।ম্যাচ রেফারির সাথে ও তারা কথা বলেন কিছুক্ষণ। তবে কিছুতেই কোন লাভ হয়নি। বিশ্ব ক্রিকেট সাক্ষী হয় প্রথম টাইম আউটের। এখানে অবশ্য বোলার উইকেট পাবেন না। বিশ্বকাপে তো বটেই, ১৪৬ বছরের ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টাইম আউট হলেন ম্যাথিউস। বিশ্বকাপের মঞ্চে এসে রেকর্ডবইয়ে নাম লেখালেন লঙ্কান অলরাউন্ডার। তবে বিব্রতকর এমন রেকর্ড তিনি নিশ্চিতভাবেই গড়তে চাননি।তবে এর রেস যেন দেখা গেছে পুরো ম্যাচ জুড়েই। প্লেয়ারদের মাঝে যেন বিরাজ করেছে আক্রমণাত্মক ভাব এবং শক্ত কথার আদান-প্রদান। আম্পায়ারকে বেশ কিছু বার তাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করতে দেখা গেছে।
এই ঘটনাটি ঘটার পর ধারাভাষ্যকার বারবার বাংলাদেশের আবেদন করা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে গেছেন। তারা এটিকে ক্রিকেট গেম স্পিরিট এর বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে এরূপ বিরুপ মন্তব্য নতুন কিছু নয়। এর আগেও বহুবার এমনটি করেছেন তারা। ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। সেখানে ক্রিকেটের সকল নিয়মাবলী "Law of cricket" বইটিতে স্পষ্টভাবে লেখা আছে। ল ৪০ অনুযায়ী বলা আছে, "an incoming batter must be in position to take guard or for their partner to be ready to receive the next ball within three minutes (2 minutes in ICC playing conditions) of the fall of the previous wicket"। অর্থাৎ ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পর মধ্যে পরবর্তী ব্যাটারকে খেলার জন্য তৈরি থাকতে হবে। পোস্ট ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে সাকিবকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, "আমি ঠিক করেছি নাকি ভুল করেছি এটা নিয়ে বিতর্ক চলবেই। কিন্তু আমি যখন মাঠে ছিলাম আমি মনে করেছি আমি একটি যুদ্ধে আছি। এবং যুদ্ধ জয় করার জন্য যা করা যায় আমার টাই করা উচিত। যেহেতু ক্রিকেট আইনে আছে তাই আমি আম্পায়ার এর কাছে আবেদন করি এবং আম্পায় আমার আবেদনের সারা দেন। এটা নিয়ে আমার আর কিছু বলার নেই। "
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ মানেই যেন এখন নতুন এক আমেজ। বাংলাদেশ গোটা বিশ্বকাপে খারাপ করলেও এই ম্যাচে জয় যেন এক সান্তনা পুরস্কারের মত। কোটি ভক্তের এতদিনের কান্নার পর এ জয় জন্য একটু স্বস্তির। বাংলাদেশ দল আবারো জয়ের ছন্দে ফিরুক এবং সামনে আরো ভালো করুক এই প্রত্যাশাই যেন গোটা বাংলাদেশবাসীর এবং টাইগার শিবিরে।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার বার্তা/জেএইচ