হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউজে আগুন লাগার পর থেকে তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই সামনে আসছে নতুন সব অসঙ্গতি। আগুন নেভার পর ভল্টের তালা ভাঙা, অস্ত্র–গুলি উধাও, রেজিস্টার খাতায় ‘সব ঠিক আছে’ লেখা—এসব বিষয় এখন তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বারের মতো সংবেদনশীল জায়গায় এমন ঘটনা নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ভঙ্গুরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

আগুন লাগার রাতের সিসিটিভির প্রতিটি ফ্রেম খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিডিআর বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে কারা কোথায় ছিলেন, কার সঙ্গে কথা বলেছেন। বিমান, বেবিচক, পুলিশ ও আনসারের মোট ১৭ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। তাঁদের প্রোফাইল সংগ্রহ করা হয়েছে; জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে কয়েক দিনের মধ্যেই।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষায়, সবচেয়ে বড় অসঙ্গতিটি ধরা পড়েছে রেজিস্টার খাতায়। দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা রুটিনমাফিক লিখেছেন—‘সব ঠিক আছে’। কিন্তু তখনই ভল্টের তালা ভাঙা ছিল, অস্ত্র–গুলি গায়েব। তদন্তকারীরা বলছেন, দায়িত্ব পালনের বিবরণ আর সিসিটিভির ফুটেজের মধ্যে বড় ধরনের ফাঁক রয়েছে।

ঘটনার দিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন বিমানের তিনজন, পুলিশের তিনজন ও আনসারের দুই সদস্য। রাত ১০টার পর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন আরও নয়জন। এই দুই শিফটের মাঝের সময়েই ভল্ট ভাঙা এবং অস্ত্র–গুলি উধাও হয়েছে বলে মনে করছে তদন্ত দল। ইতোমধ্যে ১২৮টি সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্ত কার্গো হাউজ পুনর্নির্মাণ নিয়েও নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ভবনটি না ভেঙে নতুন শেড তৈরির পরিকল্পনা করা হলেও একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হাতে কাজ পাইয়ে দিতে সরকারের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ভাইয়ের পক্ষে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ উঠেছে বেবিচকের ভেতর থেকেই। বিষয়টি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে। বুয়েটের পরামর্শ নেওয়া হলেও ঠিকাদার বাছাইকে কেন্দ্র করে এই চাপ তদন্তকে আরও জটিল করে তুলেছে।

তদন্তে উঠে এসেছে অস্ত্র–গুলি খোয়া যাওয়ার সম্ভাব্য সময়সীমাও। ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে ২৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে কেউ ভল্টে প্রবেশ করে অস্ত্র–গুলি বের করে নিয়ে গেছে বলে ধারণা মিলেছে। ওই সময় ভল্টে ঢোকার সুযোগ ছিল মাত্র কয়েকজনের। তাঁদের কারও গাফিলতি, কারও বা সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে মনে করছে তদন্ত দল। বিমান সন্দেহভাজনদের তলব করেছে, তবে এখনো কোনো মামলা করেনি—যা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

সমগ্র ঘটনায় বিমান, বেবিচক, কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যে এখন চলছে দায়িত্ব এড়ানোর দৌড়ঝাঁপ। বিমান বলছে কুরিয়ার গোডাউনের নিরাপত্তা তাদের দায়িত্ব নয়; বেবিচক বলছে কুরিয়ার সংস্থাকে শুধু ভাড়া দেওয়া হয়েছে; তদন্তকারীরা বলছেন রোস্টারের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।

সব মিলিয়ে কার্গো হাউজের অগ্নিকাণ্ড এখন আর শুধু আগুনের ঘটনা নয়। এটি পরিণত হয়েছে নিরাপত্তা ভাঙন, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং সম্ভাব্য লুটচক্রের জটিল এক তদন্তে। তদন্তকারীদের মতে, আগুন ছিল কেবল শুরু; এর আড়ালে আরও বড় ঘটনা লুকিয়ে আছে। সূত্র : দেশরূপান্তর

আমার বার্তা/জেএইচ