জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে টানাপড়েন। একাধিক দল অংশ নিচ্ছে আলোচনায়, দেওয়া হচ্ছে প্রস্তাবও। তবে এখনো পাওয়া যাচ্ছে না চূড়ান্ত ঐকমত্য। মূল প্রশ্ন এখন, সনদ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ কবে এবং কীভাবে আসবে? রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার মধ্যেই বিষয়টির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।
বিএনপি ও তাদের সমমনা জোট আলোচনা চালিয়ে যেতে চাইলেও জামায়াতে ইসলামী বলছে, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোট ছাড়া তারা কোনো প্রক্রিয়াকে গ্রহণ করবে না। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো গণপরিষদ গঠনের দাবিতে অনড়।
গণঅধিকার পরিষদ মনে করে, সব রাজনৈতিক দলকে এক জায়গায় আনা সম্ভব নয়। তাই বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে এখন দায়িত্ব সরকারের কোর্টেই।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নতুন করে বৈঠক হয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল, এনসিপি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে। এই অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মূলত আলোচনা হয়েছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি কীভাবে শক্ত করা যায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য কীভাবে কমিয়ে আনা যায়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, তারা সরকারের কাছে একাধিক বাস্তবায়ন প্রস্তাব রাখতে চায়। তবে এই কমিশনের কোনো বাস্তবায়ন ক্ষমতা নেই। তাদের কাজ কেবল পরামর্শ দেওয়া। সনদ তৈরির কাজ তারা করেছে, পরবর্তী পদক্ষেপ সরকারের।
কমিশনের আলোচনায় উঠে এসেছে, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের আওতায় অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে একটি সংবিধান আদেশ (কনস্টিটিউশন অর্ডার) জারি করতে পারে। এতে সনদের মূল সংস্কারগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং আদেশটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। চাইলে আদেশের সঙ্গে গণভোটের ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে। জনগণ যদি ওই আদেশকে গণভোটে সমর্থন করে, তবে সেটি কার্যকর হিসেবে গণ্য হবে।
তবে সমস্যা হলো—বর্তমানে দেশে গণভোট সংক্রান্ত কোনো স্পষ্ট আইন নেই। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে সংবিধান আদেশের মাধ্যমেই গণভোট আয়োজনের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে, অথবা আলাদা করে গণভোটের আদেশও জারি হতে পারে।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে গণভোটে সম্ভাব্য প্রশ্ন হিসেবে এমন কিছু ভাবা হচ্ছে, আপনি কি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব সমর্থন করেন?
তবে এই বিষয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। জুলাই সনদের মোট ৮৪টি প্রস্তাবনার মধ্যে অনেকগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্য হয়েছে। তবে বেশ কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, অর্থাৎ মতবিরোধ। এতগুলো ভিন্নমতের মধ্য দিয়ে গণভোট কীভাবে হবে, সেটিও এখনো পরিষ্কার নয়।
বিএনপি ও তাদের মিত্ররা পরামর্শ দিচ্ছে, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এসব সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, গণভোট হলে ফল নেতিবাচকও হতে পারে, তখন করণীয় কী হবে, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, কমিশনের কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ একত্রিত করে সরকারকে সুপারিশ দেওয়া। তিনি বলেন, আমরা কাউকে কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। না দলগুলোকে, না সরকারকে। আমাদের কাজ হলো প্রস্তাব তৈরি করা। বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের।
তিনি জানান, কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব বিশেষজ্ঞদের কাছে তুলে ধরেছে। তারা এগুলো পর্যালোচনা করছে। দলগুলোও নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে প্রস্তাবগুলো কমিয়ে এনে একটি বা কয়েকটি প্রস্তাবে ঐকমত্যে আসা যায়।
ড. আলী রীয়াজ আরও বলেন, বিশেষজ্ঞ প্যানেল তাদের একত্রীকৃত সুপারিশ আমাদের দিয়েছে। তারা বলেছে, গণভোট করা সম্ভব। এখন দলগুলোর ঐকমত্য হলে কমিশন সরকারকে প্রস্তাব দিতে পারবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা আলোচনায় আছি, প্রস্তাব দিচ্ছি। যদি বিলম্ব হয়, তাহলে অসাংবিধানিক শক্তি এই সুযোগ নিতে পারে। সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়নে যারা বাধা দিচ্ছে, জনগণ তাদের প্রতিহত করবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না।
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিনের মতে, সংবিধানের যেসব মৌলিক অংশ সংশোধন করা হচ্ছে, সেগুলো যদি আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়, তবে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাই গণপরিষদ গঠনই সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ও টেকসই উপায়।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, যদি জনগণ গণভোটে সনদ প্রত্যাখ্যান করে, তখন করণীয় কী হবে? এখন দলগুলো শতভাগ ঐকমত্যে পৌঁছাবে না, সেটা পরিষ্কার। কাজেই সিদ্ধান্ত এখন সরকারের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে নির্বাচনী অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে। রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়। সংলাপ চলছে, প্রস্তাব আসছে, মতপার্থক্যও রয়েছে। এর মাঝেই সময় গড়াচ্ছে।
তাদের মতে, সরকার চাইলে এখনই একটি সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে পারে। তবে সেটি করতে হলে রাজনৈতিকভাবে সরকারকে দায় নিতে হবে। আর এ দায় নেওয়ার প্রস্তুতি সরকারের আছে কি না, সেই প্রশ্নটিই এখন সামনে চলে এসেছে।
আমার বার্তা/জেএইচ