সম্প্রতি বাংলাদেশে সফর করেছেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। তার এই সফরে বেশ কিছু বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা চালানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছে কি না এবং সম্পদের সুষম বণ্টনসহ ১৯৭১ সালের বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয়ে সমাধানের কথা বলছে বাংলাদেশ।
কিন্তু ইসহাক দার তার এই সফরে দাবি করেছেন, এগুলো আগেই দু'দফায় সমাধান হয়ে গেছে। তিনি মন থেকে অতীতের স্মৃতি মুছে ফেলে দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন।
রোববার ঢাকায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানের এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিবারের মধ্যে, ভাইদের মধ্যে যখন এটার সমাধান হয়ে গেছে, এমনকি ইসলামও আমাদের বলেছে যে, তোমাদের হৃদয় পরিষ্কার করো। সুতরাং চলুন সামনে এগিয়ে যাই। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, আমাদের ভবিষ্যত উজ্জল।
তবে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর আগেই সমাধান হয়েছে বলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে দাবি করেছেন সেটার সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমি অবশ্যই একমত না। একমত হলে তো সমস্যাটা সমাধান হয়ে যেত তাদের মতো করে, তাই না? রোববার সকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেখানে অমীমাংসিত ইস্যুতে দুদেশ নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরেছেন বলে জানান তৌহিদ হোসেন।
দুই দফায় নিষ্পত্তির দাবি
পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরও দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কিছু সমস্যা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সেগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি ইস্যু হলো- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা, স্বাধীনতার সময়কার পাকিস্তানের সম্পদের সুষম বণ্টন এবং দুদেশের আটকে পড়া নাগরিকদের প্রত্যাবাসন।
এসব বিষয় নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময় দুদেশের মধ্যে নানা আলাপ-আলোচনা হতে দেখা গেলেও দৃশ্যমান কোনো সমাধান দেখা যায়নি। শনিবার পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় অবতরণ করলে নতুন করে ইস্যুগুলো সামনে আসে এবং সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন মহল থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়।
কিন্তু রোববার সকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন যে, দু'দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো অতীতে দুই দফায় সমাধান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, অমীমাংসিত ইস্যু দুবার নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে এবং ২০০০ সালের শুরুর দিকে যখন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এখানে (বাংলাদেশে) এসেছিলেন এবং তিনি গোটা পাকিস্তান জাতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে কথা বলেছিলেন।
১৯৭৪ সালে অমীমাংসিত বিষয়ের আনুষ্ঠানিক সমাধান হয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, ঐতিহাসিক সেই দলিলপত্র দুই দেশের কাছেই আছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি এখন ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র হাদিসে যেমনটা বলেছেন, সেভাবে আমাদের নতুন করে শুরু করে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা একটা পরিবার এবং আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশ চায় পাকিস্তান মাফ চাক
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার জন্য পাকিস্তান মাফ চাক বাংলাদেশ সেটা চায়। একই সঙ্গে সম্পদের ভাগও চায় বাংলাদেশ সরকার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান খুব পরিষ্কার। আমরা চাই যে হিসাবপত্র হোক এবং আমাদের টাকা-পয়সার যে ব্যাপার সেটার সমাধান হোক। আমরা চাই যে এখানে গণহত্যা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে তারা দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাক এবং আমরা চাই যে এখানে আটকে পড়া মানুষগুলো আছে তাদেরকে পাকিস্তানে ফেরত নেওয়া হোক।
রোববারের বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সে বিষয়টিই তুলে ধরেছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, আমরা তিনটি বিষয়ে (গণহত্যা, সম্পদের বণ্টন, আটকে পড়া নাগরিকদের প্রত্যাবাসন) নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছি...আমরা পরস্পর নিজেদের যে অবস্থানগুলো সেগুলো আমরা ব্যক্ত করেছি।
ইতিহাস কী বলে?
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার দুই বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় পাকিস্তান। এই ঘটনার মাত্র চার মাসের মাথায় শতাধিক ব্যক্তির একটি বিশাল বহর নিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো।
সেই সফরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় ‘তওবা’ বা অনুশোচনা প্রকাশ করে সেটার জন্য এককভাবে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসকদের দায়ী করেন ভুট্টো। বিষয়টিকে ‘বেদনাদায়ক’ বর্ণনা করে এর ইতি টেনে তখন দুদেশের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি।
ঢাকায় সফরকালীন সে সময়ে ভুট্টো বলেছিলেন, যা হয়েছে তা নিয়ে অন্তর থেকে অনুতপ্ত হতে বা তওবা করতে দেরি হয়ে যায়নি। পাকিস্তানের মানুষ আপনাদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। তারা এবং পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।
১৯৭৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বিবরণেও রয়েছে যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা তাদের (পাকিস্তানকে) ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের একটি আর্কাইভ প্রতিবেদনে, সে সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকেও অতীত ভুলে নতুন সূচনা করার এবং ক্ষমার নিদর্শন হিসেবে বিচার না চালানোর সিদ্ধান্তের কথার উল্লেখ রয়েছে।
১৯৭৪ সালের ১১ এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য আজ পাকিস্তান ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। এমন এক সময়ে এই ক্ষমাপ্রার্থনার ঘোষণা এসেছে যখন বাংলাদেশ ১৯৫ জন পাকিস্তানিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রস্তাব থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতরাতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যে চুক্তিতে সই করেছেন এরপরেই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। পাঁচ দিনের বৈঠকের পর সূক্ষ্ম এক ‘মুখ রক্ষার সমঝোতা’ তৈরি হয়েছে। মূলত পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়েই নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ফল পেয়েছে: পাকিস্তান তার সব যুদ্ধবন্দীকে ফেরত পাবে-যার মধ্যে ছিল সেই ১৯৫ জন সেনা যাদের হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের অভিযোগে বাংলাদেশ বিচারের মুখোমুখি করতে চেয়েছিল। এই বিচার স্থগিত করার বিনিময়ে পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে-যা এক অর্থে এই স্বীকারোক্তি যে, পাকিস্তানি সেনারা অযথা সহিংসতায় জড়িয়েছিল।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চুক্তিটি একসঙ্গে নয়াদিল্লি, ঢাকা ও ইসলামাবাদে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে সই করেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরন সিং, বাংলাদেশের কামাল হোসেন এবং পাকিস্তানের আজিজ আহমেদ। এতে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার যে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলে তার নিন্দা করছে এবং গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে। আরও বলা হয়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অতীত ভুলে যাওয়ার এবং ক্ষমা করার জন্য, যাতে পুনর্মিলন সম্ভব হয়।
চুক্তিতে উল্লেখ ছিল যে, বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানও ঘোষণা করেছিলেন যে, ১৯৭১ সালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে তিনি চান জনগণ অতীত ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করুক। পাকিস্তানের এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ‘দয়া প্রদর্শনের অংশ হিসেবে’ বিচার প্রক্রিয়া আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে সম্মত হয় যে, ১৯৫ জনসহ সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে।
যদিও পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। ভারত ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সে সময় দাবি করেন যে, পাকিস্তান স্পষ্টভাবেই স্বীকার করেছে যে তাদের কিছু সেনা সীমালঙ্ঘন করেছে। এমনকি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই চুক্তিতে সই করাকেও এক ধরনের ক্ষমাপ্রার্থনা হিসেবে দেখা হয়েছে।
এরপর ২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশ সফরে এসে পুনরায় দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ভাগ চাওয়া হলেও পাকিস্তানের কোনো সরকারই সেটি বুঝিয়ে দেননি।
এমনকি ১৯৭৪ সালে বিষয়গুলো নিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।
বিশেষত দায় ও সম্পদের বন্টন প্রশ্নে পাকিস্তান অযৌক্তিক মনোভাব প্রকাশ করার কারণে আলোচনা ভেস্তে গেছে বলে সে সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। ফলে বিষয়টি এখনও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাদেশের অভিযোগ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, যা আজকের বাংলাদেশ, সেখানে যুদ্ধাপরাধ চালিয়েছে। পাকিস্তান ওই অভিযোগ নাকচ করে আসলেও ১৯৭৪ সালে প্রথম দেশটি বাংলাদেশের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে।
১৯৭৪ সালে সিমলা চুক্তির পর যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। একই সময়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে আটক যুদ্ধবন্দী এবং সেখানে আটকে পড়া সাধারণ বাঙালিদের ফেরত পাঠানো সমাপ্ত করে পাকিস্তান।
তবে বাংলাদেশ ওই সময় যুদ্ধাপরাধীসহ পাকিস্তানের অন্য শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিলে পাকিস্তান তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান দাবি করে তাদের হাতে গ্রেফতার থাকা ২০০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা করার ষড়যন্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচারের অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে।
আর তাই শেষ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতা কেবল নিজেদের বন্দী নাগরিকদের ফেরত দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই সীমিত থাকে।
এই ঘটনার কারণেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এবং দেশটির কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদিকে, বাংলাদেশ তখন ঘোষণা দেয় যে তারা ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর কোন বিচার করবে না এবং তাদেরকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে। ভবিষ্যতে সহযোগিতার সম্পর্ক রাখবে এমন চুক্তি স্বাক্ষর করে দুই দেশ।
এক ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় সবার সম্মতিতে যে চুক্তি হয়, তাতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। চুক্তির বিবরণ অনুযায়ী, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা তাদের (পাকিস্তানকে) ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান।
তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের প্রধানমন্ত্রীর এমন বার্তা জানিয়ে দেন যে, তিনিও বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষমা করে, অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে বলেছেন। তিনি বলেন, কিভাবে ক্ষমা করতে হয় বাংলাদেশের মানুষ তা ভালোই জানে।
দ্বিতীয়বার, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশে সফরকালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন এবং ওই সময়ের পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে হতাশা ব্যক্ত করেন।
তাহলে বাংলাদেশ এখনো কেন দাবি করছে যে, পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা যায় যে, ১৯৫ জন বন্দী প্রত্যর্পণের সময় যে আলোচনা হয়েছিল, তখনকার সেই চুক্তিতে পরিষ্কার উল্লেখ ছিল যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশে একবার সফর করবেন এবং দেশটির জনগণের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন যে তারা যেন পেছনের কথা ভুলে যায়।
এখানে উল্লেখ করা উচিত হবে যে চুক্তিটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনামলে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চুক্তিতে সই করেছিলেন এবং লিখেছিলেন যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও জনগণকে একটি বার্তা দিয়েছেন এবং বলেছেন যে বাংলাদেশের মানুষ জানে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়, এবং ক্ষমা হিসেবে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে ফেরত পাঠাবে।
অনেক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে এটা মনে করা হয় চুক্তিটি আসলে হয়েছিল পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে, কারণ তারা ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল এবং বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে চুক্তির অংশ হতে হয়েছিল।
সে সময়, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে একে আপসরফা এবং সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ এতে সন্তুষ্ট নয়, প্রায় ৫৪ বছর পরেও এটা বিরাট একটি সমস্যা। পাকিস্তান সত্যিকার অর্থেই দুঃখপ্রকাশ করে কি না তা নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।
বাংলাদেশ সফরের সময় সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ অনুতাপ প্রকাশ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে তিনি পাকিস্তানি ভাই ও বোনদের পক্ষ হয়ে কথা বলছেন। কিন্তু পারভেজ মুশাররফের সফরের সময় বাংলাদেশের মানুষের গভীর প্রত্যাশা ছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, এটা বোঝা জরুরি যে মার্জনা মানে এই নয় যে আমরা দুঃখিত, যা হবার হয়ে গেছে। এর মানে আরো গভীর কিছু। কারণ বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে একটি সর্বাঙ্গীণ ক্ষমা প্রার্থনার প্রয়োজন ছিল।
একে হয়তো আইনতভাবে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ বলা যায় কিন্তু মানুষের কাছে এটা কোনো ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ ছিল না। ওই চুক্তিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। কিন্তু এখানে আমরা বিশ্বাস করি যে পুরো পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।
বাংলাদেশের উপলব্ধি হচ্ছে যে ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে, তার সবই হয়েছে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা-মাফিক। এর দায়িত্ব নির্ধারণ করা হোক এবং কে কী করেছে তা চিহ্নিত করা উচিত। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সরকার ক্ষমা চাক বা না চাক, বিশ্লেষকদের বিশ্বাস যুদ্ধের শিকার বহু বাংলাদেশি এখনো বুকের ভেতর কষ্ট আর চাপাকান্না নিয়ে বেঁচে আছেন, সেই ঘটনার সংশোধন এখন অপরিহার্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করা এবং দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে সে কাজ হয়তো সম্ভব হতে পারে।l
সূত্র: বিবিসি বাংলা, নিউইয়র্ক পোস্ট
আমার বার্তা/জেএইচ