২২ মে ‘বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস’। প্রতিবছর জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে এই দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয়।
জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রোগ্রামের অধীনে কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি (সিবিডি) কর্তৃক একটা করে থিমও নির্ধারণ করা হয় প্রতিবছর। এই বছরের থিম হচ্ছে, ‘হারমোনি উইথ নেচার এন্ড সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট’, অর্থাৎ ‘প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য এবং টেকসই উন্নয়ন’।
টেকসই উন্নয়ন আসলে কি? ১৯৯২ এর ধরিত্রী সম্মেলনের ‘এজেন্ডা ২১’ অনুযায়ী, পরিবেশের কোনো ক্ষতি সাধন না করে এবং মানব সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ের কোনোরূপ ব্যত্যয় না ঘটিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে মানব জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনই হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন।
ওয়ার্ল্ড কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ডব্লিউসিইডি) এর সাবেক চেয়ারম্যান ব্রুন্ডটল্যান্ডের মতে, টেকসই উন্নয়ন হলো সেই উন্নয়ন যা ভবিষ্যত প্রজন্মের সম্পদের চাহিদা পূরণের সক্ষমতাকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, বর্তমান প্রজন্মের সম্পদের চাহিদা পূরণ করে।
নিকট অতীতে আমরা শুধু উন্নয়নের কথা শুনলেও এখন বেশ জোরেশোরেই টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হয় । টেকসই উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশের উন্নয়নের জন্য টেকসই উন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা- ২০৩০ নির্ধারিত হয়। জাতিসংঘের ৭০ তম অধিবেশনে টেকসই উন্নয়নের জন্য ১৭ টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় । আর এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে মূলত ফাইভ-পি এর ওপর ভিত্তি করে।
ফাইভ-পি হচ্ছে পিপল, প্ল্যানেট, প্রসপারিটি, পিস, পার্টনারশিপ; অর্থাৎ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পৃথিবী ও পরিবেশের কোনও ক্ষতি না করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনগণের আর্থ-সামাজিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধনই হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা- ২০৩০ এর উদ্দেশ্য ।
আমাদের পরিবেশের প্রধান উপাদান হচ্ছে জীববৈচিত্র্য । পৃথিবীর মাটি, জল ও বায়ুতে বসবাসকারী সকল উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের মধ্যে যে জিনগত, প্রজাতিগত ও পরিবেশগত (বাস্তুতান্ত্রিক) বৈচিত্র্য দেখা যায় তাকেই জীববৈচিত্র্য বলে। অর্থাৎ সহজ কথায় আমাদের আশেপাশের পরিবেশে ও বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে বিদ্যমান উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের বৈচিত্র্যই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় জীববৈচিত্র্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ নিত্য প্রয়োজনীয় অধিকাংশ উপাদান আসে জীববৈচিত্র্য থেকে। এমনকি আমাদের প্রতিদিন শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যবহৃত অক্সিজেনও বায়ুমণ্ডলে অবমুক্ত হয় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উদ্ভিদ থেকে।
অথচ দ্রুতহারে বর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মিটাতে গিয়ে আমরা অপরিকল্পিতভাবে ক্রমাগত জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে ফেলছি। আমরা বনাঞ্চল কেটে নগরায়ন করছি, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে উন্নয়ন কার্যক্রমের নামে জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল নষ্ট করে ফেলছি, বনাঞ্চলের গাছ কর্তন করছি, পাখি ও বিভিন্ন বন্যপ্রাণী শিকার করছি ঠুনকো স্বার্থে।
বিভিন্ন জলজ প্রাণী যেমন কাঁকড়া, কুইচ্যা অতিমাত্রায় আহরণ করছি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য। নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা পরিবেশ দূষণ করে জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসে ভূমিকা রাখছে। যেমন- অধিকহারে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার, শিল্প-কারখানার বর্জ্য নদী বা সমুদ্রে ফেলা, ব্যাপক হারে পলিথিনের ব্যবহার । টেকসই উন্নয়নের ধারণা সামনে না থাকায় শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লাভের কথা মাথায় রেখে আমরা এমন সব কাজ করছি যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মক হুমকীর মুখে ঠেলে দিচ্ছে ।
সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেস ইনভেশন ইউনিট (জিইই) কর্তৃক ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’ নামে প্রকাশিত একটি লিফলেট পড়লাম। যার শিরোনাম ছিল ‘তৃনমূল পর্যায়ে জাতিসংঘ কর্তৃক টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন: স্থানীয় সরকার পরিপ্রেক্ষিত’। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ এর আলোকে সেখানেও ১৭টি অভীষ্ট নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার ও সাধারণ জনগণ যাতে টেকসই উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে সে উদ্দেশ্যই গাইডলাইন হিসেবে এটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এর ১১-১৫ নম্বর অভীষ্টের সবগুলোই সরাসরি পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের উন্নয়ন বিষয়ক। এর ১৪ নম্বর অভীষ্টে উল্লেখ আছে, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা ও ব্যবহার বিবেচনা করে মৎস্য ও উদ্ভিজ্জ সম্পদসহ সকল প্রকার জলজ প্রাণী ও সম্পদের নিয়ন্ত্রিত ও টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে এসব সম্পদ ও প্রাকৃতিক উপাদানের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা’।
আবার ১৫ নম্বর অভীষ্ট হচ্ছে, ‘প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন স্থানীয় বায়ুমণ্ডল, জলাধার, বনাঞ্চল পাহাড় ইত্যাদির স্বাভাবিকতা, বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, পুনরুদ্ধার, পুনঃসৃজন এবং এসব সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা’। বিভিন্ন আইন প্রন্যনের পাশাপশি স্থানীয় সরকার পর্যায়েও বেশ কাজের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততার অভাবে সেগুলো খুব একটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
টেকসই উন্নয়ন মানেই হচ্ছে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিষয়সমূহের সুষম সমন্বয় সাধন। তাই আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমের সময় টেকসই উন্নয়নকে সব সময় গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে প্রণীত আইনগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে।
এটা সব সময় মনে রাখতে হবে যে টেকসই উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ও পরস্পর নির্ভরশীল। একটির উন্নয়ন ছাড়া অন্যটি সম্ভব না।
আমার বার্তা/এল/এমই