‘জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনে করণীয় ঠিক করতে হবে বলে জানিয়েছেন আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে কোনো পরাশক্তির ছায়া-যুদ্ধক্ষেত্র করতে দেওয়া যাবে না।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর বিজয়নগরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘চট্টগ্রাম বন্দর ও মানবিক করিডর’ বিষয়ে সংবাদ সম্মলেনের আয়োজন করা হয়। সেখানে এসব কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ যেন কোনো পরাশক্তির ছায়া-যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত না হয়, সেটা সবাইকে বিবেচনায় নিতে হবে। পনেরো লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ দেশে নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবর্তনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐকমত্য জরুরি বলে অভিমত জানান তিনি।
বন্দর ও মানবিক করিডর প্রসঙ্গে দলের অবস্থান তুলে ধরে ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, বিদেশি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান মানেই জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এমন নেতিবাচক ও ষড়যন্ত্রমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য নয়। সঠিক চুক্তি, স্পষ্ট জবাবদিহিতা, কার্যকর তদারকি এবং জাতীয় স্বার্থের নিশ্চয়তা থাকলে এমন ব্যবস্থাপনা বরং উন্নয়নের গতিকে তরান্বিত করে।
তিনি বলেন, আমরা চাই, চট্টগ্রাম বন্দর যেন দক্ষ ব্যবস্থাপনার ছোঁয়ায় একটি আন্তর্জাতিক লজিস্টিক হাবে পরিণত হয়, যেখানে থাকবে সময়ের গুরুত্ব, পরিবেশ ও প্রযুক্তির ব্যবহার, স্বচ্ছতা ও সর্বোপরি জবাবদিহিতা। প্রসঙ্গক্রমে, আমরা পোশাক শিল্প ও হোটেল ব্যবস্থাপনাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। বাংলাদেশের যেসব হোটেল আন্তর্জাতিক ‘ফাইভ স্টার’ বা তারও উপরের মান ধরে রেখেছে, তাদের অধিকাংশই আন্তর্জাতিক হোটেল চেইনের (যেমন: Radisson, InterContinental, Marriott, Le Méridien) ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এতে কি জাতীয় নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? মোটেও নয়। বরং বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা থাকলে আমাদের পর্যটন, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে বলে বিশ্বাস করে এবি পার্টি।
এবি পার্টি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে চারটি বিষয়ে জাতির কাছে পরিষ্কার করার আহ্বান জানান তিনি।
১. বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যে কোনো চুক্তির আগে তাদের অতীত রেকর্ড, পরিচালন দক্ষতা এবং চুক্তির শর্তাবলী, যতটুকু সম্ভব দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার ভিত্তিতে, জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।
২. চুক্তির মাধ্যমে যেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা নিরাপত্তা কোনোভাবে আপসের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. স্থানীয় জনশক্তি, শ্রমিক স্বার্থ ও দেশের অর্থনৈতিক লাভের দিকগুলো চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সমগ্র প্রক্রিয়াকে করতে হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য।
ফুয়াদ বলেন, এবি পার্টি চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানায় এবং বিশ্বাস করে যে এই উদ্যোগ আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে নতুন অর্থনৈতিক উচ্চতায় নিয়ে যাবে, যদি তা হয় দূরদর্শী, স্বচ্ছ এবং দেশপ্রেমের ভিত্তিতে। অতীতের মতো পেছনের দরজার চুক্তি নয়, বরং জনস্বার্থ ও তথ্য-উন্মুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হলে এই বন্দর হতে পারে ‘দক্ষিণ এশিয়ার পরবর্তী সিঙ্গাপুর’-এর ভিত্তিপ্রস্তর।
তথাকথিত ‘মানবিক করিডর’ বিষয়ে ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ (বাস্তবে ১৭ থেকে ২০ লাখ) রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই বাস্তবতায় সাম্প্রতিক সময়ের ‘মানবিক করিডোর’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক ভারসাম্যের দিক থেকে গভীরভাবে মূল্যায়নযোগ্য। বুধবার বিকেলে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের বক্তব্য ও ব্যাখ্যাকে আমরা স্বাগত জানাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থান বিলম্বে হলেও পরিষ্কার করার জন্য।
ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, এবি পার্টি মনে করে, রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি আরাকান এখনো তাদের জন্য নিরাপদ নয়। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, আরাকান/রাখাইন রাজ্যে এখনো রোহিঙ্গারা সহিংসতা, বৈষম্য ও নাগরিক অধিকারহীনতার শিকার। এই পরিস্থিতিতে “মানবিক করিডর” তৈরি করা হলে তা বাংলাদেশকে অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের অংশ বানিয়ে ফেলবে, যেটা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। "রোহিঙ্গা সংকট অথবা মানবিক করিডর" রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। তাই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য দরকার। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, টেকসই ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনই একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমাধান। এটিই বাংলাদেশের আলোচনার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
এবি পার্টি মনে করে যে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা ও আত্মমর্যাদা-এ প্রশ্নে কোনো বিদেশি চাপ, আন্তঃরাষ্ট্রীয় খেলা কিংবা কৌশলগত চালচিত্র বরদাশত করা হবে না। আমরা রোহিঙ্গাদের সংকটে মানবিক কিন্তু সাহসী ও বাস্তবভিত্তিক সমাধান চাই। এবং সেই সমাধান হতে হবে-বাংলাদেশের নেতৃত্বে, বাংলাদেশ এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা করেই, দাবি করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন এবি পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল, আলতাফ হোসাইন, সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ নোমান ও ছাত্রপক্ষের আহ্বায়ক মোহাম্মদ প্রিন্স।
আমার বার্তা/এমই