ই-পেপার সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১১ কার্তিক ১৪৩২

সুইডেন: এক সভ্য রাষ্ট্রের জন্ম ও মানবতার পথচলা

রহমান মৃধা
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৪

জীবনের বড় একটি অংশ কাটিয়েছি সুইডেনে—এক দেশ, যার সভ্যতা, প্রকৃতি আর মানবিক মূল্যবোধ আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। এই দেশের ঋতুচক্র, নীরব শহরগুলো, স্নিগ্ধ মানুষ ও প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্য আমার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। বহু বছর ধরে অনেকে জানতে চেয়েছেন—কেমন এই সুইডেন? কেমন তাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাপন?

সম্প্রতি বেশ কিছু গণমাধ্যম থেকে অনুরোধ এসেছে, এই দেশ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা লিখতে। ভাবলাম, শরতের এই রঙিন মৌসুমে, যখন নর্ডিক আকাশে নর্দার্ন লাইটস নাচে নীরবে, তখনই হয়তো সময় এসেছে এই দেশের গল্প বলার।

এই লেখায় তাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি সুইডেনের ইতিহাস, জীবনধারা ও সমাজ-সংস্কৃতির সেই মানবিক ও বাস্তব চিত্র, যা আমাকে আজও মুগ্ধ করে। আশা করি পাঠকদের কাছে এটি কেবল তথ্য নয়—একটি অনুভূতির যাত্রাও হবে।

সুইডেনে মানুষের আগমন: বরফের অন্তর্গত ভ্রমণ

সুইডেনে মানুষের প্রথম পদচারণা ঘটেছিল প্রাগৈতিহাসিক ইউরোপ থেকে। প্রায় ১২,০০০–১৩,০০০ বছর আগে বরফ গলতে শুরু করলে উত্তর ইউরোপের তুষারমুক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করে শিকারি-সংগ্রাহক সম্প্রদায়। তারা সম্ভবত আজকের জার্মানি, পোল্যান্ড ও বাল্টিক অঞ্চলের বরফমুক্ত অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়।‘

সংক্ষেপে:

• উৎসস্থান: মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপ (বর্তমান জার্মানি, পোল্যান্ড)

• সময়কাল: খ্রিষ্টপূর্ব ~১০,০০০–৯,০০০

• পথ: বরফ গলনের পরে তুষারমুক্ত উত্তর ইউরোপে স্থানান্তর

প্রাচীন যুগ: গোত্র ও রাজ্যগুলোর আবির্ভাব (খ্রিষ্টপূর্ব ~১০০০ – খ্রিষ্টীয় ১০৫০)

সেই সময় সুইডেন কোনো একক রাষ্ট্র ছিল না। এখানে বিভিন্ন নর্ডিক গোত্রের বাস ছিল, বিশেষ করে Svear (যাদের নাম থেকেই এসেছে “Sverige” অর্থাৎ “Svear-এর রাজ্য”) এবং Götar। এই গোত্রগুলোতে বাণিজ্য, সংঘর্ষ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় চলত, যার মধ্য দিয়ে ক্রমে গড়ে উঠছিল একটি বৃহত্তর নর্ডিক পরিচয়।

ভাইকিং যুগ: অভিযান ও বাণিজ্যের প্রাচীর (৭৯০–১০৫০ খ্রিষ্টাব্দ)

সুইডিশ ভাইকিংরা এ সময় পূর্ব দিকে — রাশিয়া, বাল্টিক অঞ্চল এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য পর্যন্ত — অভিযান চালাত এবং বাণিজ্য করত। ধীরে ধীরে রাজারা গোত্রভিত্তিক এলাকা একত্র করে কেন্দ্রীভূত শাসনের দিকে অগ্রসর হন।

ঐক্যবদ্ধ রাজ্যের সূচনা (১১শ শতাব্দী)

১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রজা Olof Skötkonung সমগ্র সুইডেনের প্রথম খ্রিষ্টান রাজা হন। তার শাসনামলে খ্রিষ্টধর্ম রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হয় এবং রাজতান্ত্রিক কাঠামোর সূচনা ঘটে। ইতিহাসবিদেরা এই সময়কে সাধারণত ‌‘সুইডেনের জন্ম’ বা রাষ্ট্রের প্রাথমিক রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

মধ্যযুগ থেকে আধুনিক রাষ্ট্র (১২শ–১৬শ শতাব্দী)

রাজতন্ত্রের পাশাপাশি চার্চ ও স্থানীয় অভিজাতদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ১৩৯৭ সালে Kalmar Union গঠিত হয়, যেখানে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেন একই রাজতন্ত্রের অধীনে আসে। কিন্তু ডেনিশ আধিপত্যে অসন্তুষ্ট সুইডিশরা বিদ্রোহের পথে হাঁটে।

আধুনিক সুইডেনের জন্ম (১৫২৩)

গুস্তাভ ভাসা (Gustav Vasa) ডেনমার্কবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৫২৩ সালের ৬ জুন তিনি রাজা নির্বাচিত হন—এই দিনকেই আধুনিক সুইডেন রাষ্ট্রের জন্মদিন হিসেবে ধরা হয়। আজও এদিন “Sveriges nationaldag” বা জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়।

আধুনিকীকরণ ও নিরপেক্ষতার যুগ (১৭শ শতাব্দী থেকে)

১৭শ শতকে সুইডেন ইউরোপের অন্যতম সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়, বিশেষ করে Gustavus Adolphus-এর নেতৃত্বে। তবে ১৮শ–১৯শ শতকে একাধিক যুদ্ধের পর, বিশেষ করে Napoleonic Wars-এর শেষে, সুইডেন যুদ্ধবিমুখ ও নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। ১৯০৫ সালে নরওয়ের সঙ্গে ইউনিয়ন ভেঙে সুইডেন পূর্ণ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

স্বদেশ ত্যাগ ও আমেরিকা অভিবাসন (১৮০০–১৯০০)

১৮০০–১৯০০ শতকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিক্ষেত্রে সমস্যা ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে লাখ লাখ সুইডিশ মানুষ স্বদেশ ত্যাগ করে। তারা মূলত আমেরিকার মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে (বিশেষ করে মিনেসোটা, উইসকনসিন, ইলিনয় ও মিচিগান) বসতি স্থাপন করে। নতুন দেশে তারা কৃষি ও সামাজিক দক্ষতা সঙ্গে নিয়ে সুইডিশ সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করে।

আজকের সুইডেন: এক মানবিক রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি

সুইডেন আজ সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থায় পরিচালিত একটি উন্নত কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এর ইতিহাস শান্তিপূর্ণ ও মানবিক নীতিতে সমৃদ্ধ, যা একে বিশ্বের ন্যায় ও মানবতার প্রতীক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।

সুইডেনের জন্মের স্বার্থকতা: এক সভ্য রাষ্ট্রের বিবর্তন

সুইডেনের জন্ম শুধু ভৌগোলিক সীমারেখার সৃষ্টি নয়; এটি ছিল মানবিক শৃঙ্খলা, ন্যায় এবং দায়িত্ববোধের এক সভ্য রূপের উদ্ভব। ১৫২৩ সালে গুস্তাভ ভাসার নেতৃত্বে শুরু হওয়া স্বাধীনতার যাত্রা ধীরে ধীরে এক অনন্য সামাজিক দর্শনে রূপ নেয়—

‘রাষ্ট্র মানুষকে শাসন করবে না বরং মানুষের জীবনকে মর্যাদা দেবে।’ এই ধারণাটিই সুইডেনের রাষ্ট্রীয় আত্মা।

কেন সুইডেন বিশ্বখ্যাত: নৈতিকতা, উদ্ভাবন ও মানবকল্যাণের মেলবন্ধন

(১) মানবিক রাষ্ট্রদর্শনের উদাহরণ

(২) গণতন্ত্রের নৈতিক উৎকর্ষ

(৩) শিক্ষা ও উদ্ভাবনের শক্তি

(৪) নিরপেক্ষতার মহিমা

(৫) প্রকৃতি ও মানুষ: সহাবস্থানের নীতি

Livsmedel — সুইডিশ সমাজ ও সংস্কৃতির এক মূল শব্দ

অর্থ: Livsmedel শব্দের অর্থ — “জীবনের উপকরণ” (liv = জীবন, medel = মাধ্যম)। ব্যবহারিকভাবে এর মানে খাদ্যপণ্য হলেও এর দর্শন অনেক গভীর— এটি জীবনের সঙ্গে নৈতিকতা, সম্পর্ক ও প্রকৃতির সংযোগের প্রতীক। এই একটি শব্দেই নিহিত সুইডিশ সমাজের জীবনদর্শন।

জাতি হিসেবে সুইডেনের অনন্যতা

(১) নম্রতা ও শৃঙ্খলা — অহংকার নয়, পরিমিতি ও আত্মসমালোচনা।

(২) বিশ্বাসের সংস্কৃতি — প্রশাসন ও নাগরিকের পারস্পরিক আস্থা।

(৩) লিঙ্গসমতা — নারীর মর্যাদা রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের অংশ।

(৪) “Lagom” দর্শন — যথেষ্ট, কিন্তু অতিরিক্ত নয়।

(৫) মানবতার কণ্ঠস্বর — শান্তি ও মানবাধিকারে সুইডেন এক নৈতিক মডেল।

সারকথা

সুইডেনের জন্ম তাই শুধুই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা নয়— এটি ছিল মানবিক দর্শনের জন্ম, যেখানে রাষ্ট্র নয়, মানুষই সর্বোচ্চ মূল্যবোধ।

‘সুইডেনের স্বার্থকতা তার অর্থনীতিতে নয়, তার মানবতাবোধে— যে জাতি প্রমাণ করেছে, সভ্যতার আসল মাপকাঠি হলো ন্যায়, আস্থা ও সহমর্মিতা।’

সুইডিশ জীবনদর্শনের মূল দর্শনসমূহ

১. Lagom — যথেষ্ট, কিন্তু অতিরিক্ত নয়: ‘যতটা প্রয়োজন, ততটাই যথেষ্ট।’

২. নিরপেক্ষতা নয়, নৈতিক সাহস।

৩. নেতৃত্ব মানে নম্রতা।

৪. উদ্ভাবনের নীরব বিপ্লব।

৫. সুখের রাজনীতি।

৬. প্রকৃতি ও জীবনের মেলবন্ধন।

৭. মানবতার কণ্ঠস্বর।

রহমান মৃধা

গবেষক ও লেখক

সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

মৌসুমের প্রিয় রঙে নুসরাত ফারিয়া

ঢালিউডের অন্যতম দাপুটে নায়িকা নুসরাত ফারিয়া। অভিনয় থেকে শুরু করে গ্ল্যামার, উপস্থাপনা কিংবা আইটেম গানে

রোহিঙ্গা সংকটের বাস্তবতা ও সমাধান বিশ্বমঞ্চে নিয়মিত উপস্থাপনের আহ্বান

রোহিঙ্গা সমস্যা মানবিক সংকটের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক সমস্যা এবং এই সংকটের সমাধান রাজনৈতিকভাবেই হতে হবে।

ভারতে মুসলিম ঘৃণা যেভাবে নিত্যদিনের বিনোদন হয়ে উঠেছে

ভারতে আজকাল দিন শুরু হয় দুই ধরনের সংবাদ দিয়ে: একদিকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়—পাকিস্তানবিরোধী বিতর্ক,

মিয়ানমারে নির্বাচন প্রস্তুতি আরাকান আর্মির রোহিঙ্গা সংযোগ

মিয়ানমারের চলমান সংকট একটি রাজনৈতিক সমস্যা, এবং রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক পদক্ষেপের অংশ
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ক্ষমতায় এলে নারীদের ডিউটি ৫ ঘণ্টা করবো: জামায়াত আমির

মেথি শাক খাওয়ার উপকারিতা জেনে নিন

জুলাই আন্দোলনে ভুয়া মামলায় ৩৭২ জনকে অব্যাহতি

নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থী মামদানির প্রশংসায় ইলন মাস্ক

আমিরাতে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই বাংলাদেশি নিহত

কাদের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে চায় বিএনপি, জানালেন সালাহউদ্দিন

পাকিস্তানি বাজারে পণ্যের শুল্ক-কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার চেয়েছে ঢাকা

২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপির তদন্ত চাইলেন ট্রাম্প

রাবির চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের অনশনরত ৫ শিক্ষার্থী অসুস্থ

উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্য নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’, সরকারের বিবৃতি

আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ৭৬১

১৭ কোটি মানুষের জন্য একটি ক্যান্সার হাসপাতাল, এর সক্ষমতাও দুর্বল

নফল রোজা রাখার পর পিরিয়ড শুরু হলে করণীয়

মেট্টোরেল ও সব ফ্লাইওভারের বিয়ারিং প্যাডের মান নির্ণয়ে হাইকোর্টে রিট

গোপালগঞ্জে গণঅধিকার পরিষদের ৪৯ নেতার পদত্যাগ

জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা দাবির কারণ কী?

শ্লীলতাহানির শিকার অজি ক্রিকেটার, ভারতীয় মন্ত্রীর মন্তব্যে নতুন বিতর্ক

গাজায় কোন বিদেশি বাহিনী প্রবেশ করবে তা নির্ধারণ করবে ইসরায়েল: নেতানিয়াহু

নিউইয়র্কে আগাম ভোটে এগিয়ে মুসলিম মেয়র প্রার্থী, চটেছেন ইহুদি ধর্মগুরুরা

উত্তরা থেকে মতিঝিল মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক