পর্যটনের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একে অপরের সংস্কৃতি যেমন, খাদ্যাভাস, পোশাক, লোকনৃত্য, সংগীত এবং জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পারে। যা তাদের মধ্যে একধরণের সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটায়। মানুষ জন্মগতভাবে একদেশ থেকে অন্যদেশ ভ্রমণ করে অজানাকে জানার নেশায় আর প্রকৃতিগতভাবে মানুষ চায় জাতি বা গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে। মানুষের অতৃপ্ত মনের সাধ, অজানাকে জানার অদম্য ইচ্ছা এবং বিনোদনের সমস্ত উপকরণ নিয়েই আজকে গড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। পর্যটন এখন শুধু ব্যক্তিগত আনন্দের খোরাক নয়, এটি সংস্কৃতির সেতুবন্ধন। সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির সামাজিক গোষ্ঠীর চিন্তা, কর্ম, আচরণ ও বিশ্বাস এবং উৎসবের বর্হিপ্রকাশ।
সারা পৃথিবীতে সাংস্কৃতিক পর্যটন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ বিচিত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী। এই দেশে সারাবছর কোন না কোন উৎসব লেগেই থাকে। ঈদ বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব। ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের ভ্রমণের আগ্রহ ও চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিগত কয়েক বছর থেকে ভ্রমণপিপাসু মানুষের আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঈদকালীন ভ্রমণ। ঐতিহ্যগতভাবে ঈদের ছুটিতে মানুষ শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে শহরে ছুটে যায়। কারণ, এই সময়ে বেশ লম্বা ছুটি পাওয়া যায়। তাই তারা পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। তবে বর্তমানে সেই প্রথার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে মানুষ তাদের কিছুটা সময় অবকাশ যাপনের জন্য দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ যুগোপযোগী শিল্প হচ্ছে পর্যটন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি একটি অপার সম্ভাবনাময় শিল্প। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও পর্যটনের রয়েছে অসীম সম্ভাবনা। বাংলাদেশের অপরিসীম নয়নাভিরাম সৌন্দর্য পর্যটকদের হৃদয় স্পর্শ করে। সমতল ভূমির এই দেশটিকে প্রকৃতি দুই হাত খুলে সাজিয়ে দিয়েছে। আমাদের নাতিশীতোঞ্চ আবহাওয়া পর্যটনের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এমন আবহাওয়া পৃথিবীতে বিরল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশ বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় বরফে ঢাকা থাকে, কিন্তু আমাদের সেই সমস্যা নেই। আমাদের দেশে পর্যটকরা সারাবছরই ঘুরে বেড়াতে পারে। আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক এবং ভ্রমণকারী এদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এদেশে রয়েছে। আমাদের আছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। এছাড়া শৈবাল দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন, রামুর বৌদ্ধ মন্দির, হিমছড়ির ঝর্ণা, ইনানী সমুদ্র সৈকত, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওড়, টেকনাফ সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ী অঞ্চল দেখে কেউ কেউ আত্মভোলা হয়ে যায়। আবার আমাদের দেশে অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানও রয়েছে। বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর মাজার, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি পূণ্যভূমি সিলেট দেশের পর্যটন শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। প্রাকৃতিক ভূসর্গ হিসেবে সিলেট পরিচিত। শুধু দেশীয় নয়, বরং বিদেশী পর্যটক ও দর্শনার্থীদের কাছেও সমানভাবে জনপ্রিয়।
জাতিসংঘের বিশ্বপর্যটন সংস্থা ইউএনডব্লিউটিও-এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটিরও বেশি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করে এশিয়ার দেশগুলোতে। যেভাবে আমাদের দেশে দেশী ও বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে অচিরেই এই সেক্টর একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে পরিণত হবে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের এ শিল্প অনেকটা আড়ালে পড়ে রয়েছে।
সুজলা সুফলার বাংলাদেশের জন্য পর্যটন একটি বহুমাত্রিক শিল্প। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই শিল্প যার নমুনা পাওয়া যায় জিডিপিতে। ২০১০ সালে জিডিপির শতকরা এক দশমিক সাত ভাগ এসেছে পর্যটন থেকে। বর্তমানে সেই অবদান চার দশমিক তিন ভাগ। সরকার টার্গেট করেছে ২০২৭ সালে এই হার শতকরা প্রায় সাত ভাগ হবে। পর্যটন খাতে চাকরির সম্ভাবনা অনেক। বিশ্বে প্রতি ১০টিতে একটি চাকরি পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্য মতে, চলতি বছরের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের চলমান সম্ভাবনার অর্থনীতি।
পর্যটন যে আমাদের অর্থনীতির একটি বিশাল খাত হতে পারে সেই ধারণার বিকাশ ঘটে মূলত পঞ্চাশের দশকে। এরপর ১৯৯৯ সালে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার পর্যটন কর্পোরেশনের মাধ্যমে এ শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। যার ধারাবাহিকতায় ‘ট্যুরিজম বোর্ড’ ২০১০ সালে গঠন করা হয়।
বাংলাদেশে পর্যটনের যাত্রা অনেক আগে শুরু হলেও নানা প্রতিকূল অবস্থা পেরিয়ে আজকে আশার আলো ছড়াচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাসমূহের নৈমিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপার সম্ভাবনাময় আমাদের এই বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আদর্শ পর্যটন নগরী, যা শুধু অর্থনৈতিক চাকাকে সচল করবে না, সেই সঙ্গে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরবে। বাংলাদেশ পর্যটন পুলিশের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় ৮০০-এর বেশি পর্যটন স্থান রয়েছে। এসব স্থানকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত করা গেলে তা এই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। যে কোন ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদনের লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ব্যবহার পারে টেকসই উন্নয়ন সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে। তাই, গবেষণাধর্মী কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপযোগী তথ্যের উদ্ঘাটন ও সংরক্ষণপূর্বক তা নিঃসন্দেহে জনকল্যাণে সমৃদ্ধি আনয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। অপার সম্ভাবনাময় ও প্রাকৃতিকভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও মহান স্বাধীনতা অর্জনের ৫৪ বছরেও আমরা পুরোপুরি সক্ষম হয়নি পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজাতে।
পর্যটন শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়নে সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের এই ধারণাকে অনুসরণ করে বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচী গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। অর্থাৎ পর্যটনের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। শুধু বিনোদনই নয়, অর্থনীতির প্রয়োজনে ও আমাদের এই শিল্পকে নিয়ে কাজ করতে হবে। সম্ভাবনার বাংলাদেশে পর্যটনের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কিছু কার্যকর পদক্ষেপ। পর্যটনের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আমাদের পর্যটন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জড়িত। তাই একটি সিদ্ধান্ত নিতে হলে অনেক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। পরবর্তী সময়ে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। থাইল্যান্ডে পর্যটন শুধু পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাদের অন্য কোন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হতে হয় না। ফলে, সে দেশের পর্যটন এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে। আমরাও যদি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে পারি, তাহলে পর্যটনকে কাজে লাগিয়ে আয় অনেক বাড়ানো সম্ভব। তাছাড়া পর্যটনের উন্নয়নে পররাষ্ট্রনীতিমালা সহজীকরণ, ভিসা-জটিলতা দূরীকরণ, পর্যটনের স্থানগুলোর সৃজনশীল প্রচারণা, পর্যটন বিশেষজ্ঞদের গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সরকারের সুনজরও জরুরী। সংশ্লিষ্টদের উচিত, দীর্ঘমেয়াদী একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা। যেখানে পর্যটনের বিকাশে একটি রোডম্যাপ থাকবে। সর্বোপরি পর্যটন এলাকার মানুষকে উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে অর্থাৎ কমিউনিটি পার্টিসিপেশন নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় মানুষকে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পর তারা যখন এটিকে নিজের শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেবে, তখনই এই শিল্পের প্রকৃত উন্নয়ন সাধিত হবে। বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য অবলীলায় আকৃষ্ট হবে দেশী-বিদেশী ভ্রমণপিপাসুরা।
লেখক : স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক আমার বার্তা, অর্থ সম্পাদক, গ্লোবাল এভিয়েশন এন্ড ট্যুরিজম জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন।