ই-পেপার বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

মে দিবসের সংকট ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

বিল্লাল বিন কাশেম:
৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৯

শ্রমিকের ঘামেই সভ্যতার অট্টালিকা। কিন্তু আজ, শ্রমিক দিবস যেন কিছুটা কৃত্রিমতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। একদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা, কিছু আনুষ্ঠানিক মিছিল-মিটিং, ব্যানার-ফেস্টুনের বাহার—তারপর ৩৬৫ দিনের অবহেলা! প্রশ্ন জাগে, কেন শ্রমিক দিবস একদিনের আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যাচ্ছে? আসলে এ সংকট গভীর। এর শেকড় রয়েছে আমাদের সামষ্টিক চেতনায়, অর্থনৈতিক কাঠামোয় এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে।

মে দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৮৮৬ সালের ১ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকরা কাজের নির্ধারিত সময় ৮ ঘণ্টা করার দাবিতে আন্দোলন করেছিল। হে মার্কেটের সেই বিক্ষোভে বহু শ্রমিক জীবন দিয়েছেন। তাদের রক্তের বিনিময়ে বিশ্বে ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই দিন থেকেই "মে দিবস" বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের অধিকারের প্রতীক হয়ে আছে।

কিন্তু বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এখন এই ইতিহাস শুধুমাত্র বইপত্র আর বক্তৃতার বিষয় হয়ে গেছে। বাস্তব জীবনে শ্রমিকের কাজের সময়, জীবনমান বা অধিকার কতটুকু উন্নত হয়েছে, সেটি ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।

আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে মে দিবস

বর্তমানে মে দিবসের উদযাপন মূলত কিছু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ। সরকারি ছুটি, কিছু বড় সমাবেশ, রাজনৈতিক নেতাদের ভাষণ, পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র—এসব দিয়েই দায়সারা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, শ্রমিকের মৌলিক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো এই আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

শ্রমিকদের একটি বড় অংশ জানেই না মে দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য কী। কারখানার মজুর, কৃষিজ শ্রমিক, গৃহকর্মী বা নির্মাণ শ্রমিক—তাদের অনেকের দিন কাটে দিনমজুরিতে, অনিশ্চয়তায়। শ্রমিক দিবসে তাদের অংশগ্রহণ নেই, নেই সচেতনতা। ফলে মে দিবস এক ধরনের 'ঊর্ধ্বমুখী' অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার শিকড় সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত নয়।

সংকটের কারণসমূহ

রাজনৈতিক কৌশলগত ব্যর্থতা: শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে এখন আর ঐক্যের স্পৃহা নেই। দলাদলি, বিভাজন, রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে ওঠা—এসবের ফলে শ্রমিকদের প্রকৃত দাবি ও অধিকার অনেক সময় দলীয় স্বার্থের নিচে চাপা পড়ে।

নব্য উদারবাদী অর্থনীতির চাপ: বিশ্বায়নের যুগে শ্রমিককে আর শ্রমিক হিসেবে নয়, বরং 'ম্যানেজেবল রিসোর্স' হিসেবে দেখা হয়। গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের চাপে স্থানীয় শ্রমিকরা স্বল্প মজুরি ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশের বলি হচ্ছে। মালিকপক্ষ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার কথা বলে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে।

শ্রম আইন প্রয়োগের দুর্বলতা: বাংলাদেশে শ্রম আইনের সংস্কার হলেও বাস্তবায়ন এখনো দুর্বল। শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি, বেতন বকেয়া, যৌথ দরকষাকষির অধিকার খর্ব করার মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলেছে। অথচ যথাযথ আইন প্রয়োগ হলে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারত।

শ্রমিকদের আত্মসচেতনতার অভাব: বিভিন্ন শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, আন্দোলন কিংবা সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ঘাটতির কারণে শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অনেক সময় ওয়াকিবহাল নয়। ফলে শোষণের চক্র অব্যাহত থাকে।

গণমাধ্যমের ঔপনিবেশিক দৃষ্টি: প্রধানধারার গণমাধ্যম শ্রমিক ইস্যুকে গুরুত্ব দেয় না। বছরে একদিন, ১ মে এলেই কিছু বিশেষ ফিচার ছাপায়, এরপর বাকিটা বছর শ্রমিকের দুঃখগাথা অদৃশ্য হয়ে যায়।

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ: কী করতে হবে?

১. আত্মসমালোচনা ও নবীন নেতৃত্বের উত্থান: শ্রমিক সংগঠনগুলিকে নিজেরাই আত্মসমালোচনা করতে হবে। ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব পরিহার করে একটি সুসংহত নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে, যারা শ্রমিকের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত থাকবে। তরুণ, শিক্ষিত, সচেতন শ্রমিক প্রতিনিধিদের সামনে আনতে হবে।

২. নতুন শ্রমিক চেতনার প্রয়োজন: শুধু মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন নয়, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, সামাজিক মর্যাদা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন—এসব বিষয়কে একত্রে নিয়ে নতুন ধারার শ্রমিক চেতনা গড়ে তুলতে হবে।

৩. শ্রমিকের জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানো: চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে শ্রমিকদের শুধু হাতে কাজ করলেই চলবে না; মেশিন চালানো, সফট স্কিল, আইটি জ্ঞান—এসবের ওপর দক্ষতা অর্জন করাতে হবে। তা না হলে অদক্ষ শ্রমিকরা চাকরির বাজার থেকে ঝরে পড়বে।

৪. সরকারি ভূমিকার পুনর্নির্ধারণ: সরকারকে শুধু নীতিনির্ধারক নয়, কার্যকর রেগুলেটর হিসেবেও কাজ করতে হবে। নিয়মিত মনিটরিং, দ্রুত শ্রম আদালতের কার্যক্রম, যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণ ও শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তার বলয় গড়ে তুলতে হবে।

৫. গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা: আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এবং বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী প্ল্যাটফর্মে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। ফ্যাশন, প্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ন্যায্য ট্রেড চুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

নতুন করে মে দিবসের দর্শন আবিষ্কার

মে দিবসের মূল শিক্ষা ছিল — শ্রমিকের সম্মান ও অধিকার। বর্তমান বাস্তবতায় সেই শিক্ষাকে আধুনিক করে নতুনভাবে প্রচার করা জরুরি। শ্রমিক দিবসকে শুধু ছুটির দিন নয়, সচেতনতা ও সংগঠনের দিন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

প্রত্যেক শ্রমিক সংগঠন, প্রতিটি শিল্প মালিক, প্রতিটি সরকারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজের উচিত, মে দিবসের তাৎপর্যকে বছরের প্রতিটি দিনে জীবন্ত করে তোলা। শ্রমিক যদি অবহেলিত থাকে, তবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কখনোই টেকসই হবে না। উন্নয়ন মানে কেবল পরিসংখ্যানের ঊর্ধ্বমুখী রেখা নয়; উন্নয়ন মানে মানুষের জীবনমানের সার্বিক উন্নতি।

শ্রমিক দিবসের সংকট কাটিয়ে সত্যিকারের শ্রমিকবান্ধব সমাজ গঠনের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। মে দিবস হোক নতুন অঙ্গীকারের দিন — যেখানে শ্রমিকের অধিকার, মর্যাদা ও জীবনমান নিশ্চিত হবে। একদিনের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে শ্রমিকের সারাবছরের জীবন সংগ্রামকে মূল্যায়ন করতে হবে।

তবেই "মে দিবস" হয়ে উঠবে কেবল অতীতের এক ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য এক কার্যকর প্রেরণা। আর তখনই বলতে পারব—শ্রমিক দিবস আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, শুধুমাত্র একদিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গণসংযোগ কর্মকর্তা

আমার বার্তা/বিল্লাল বিন কাশেম/এমই

আইনের শাসনই রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আইনের শাসন। এই শাসন

জাগ্রত ছাত্র জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার পথরেখা

একটি জাতির চেতনার শিখা জ্বলে ওঠে যখন তার যুবসমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। আমাদের দেশের

মে দিবসের গল্প : লাল প্যাঁচা

“যারা রক্ত দিয়ে অধিকার আনে, তাদের ঘাম দিয়ে নতুন ইতিহাস লেখা যায়। আর যারা ঘামেও

ইসরায়েল গাজা ও লেবাননের উপর আগ্রাসন বন্ধ করবে কবে?

জাতিসংঘ কর্তৃক ইসরায়েল গাজার যুদ্ধবন্ধের শান্তিচুক্তি সম্পাদন হলে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। এক সপ্তাহ না
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আইসিসি থেকে পুরুষ ক্রিকেটারদের র‍্যাঙ্কিংয়ের হালনাগাদ প্রকাশ

ইউক্রেনের সঙ্গে চুক্তির ফলে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় হবে: ট্রাম্প

এ বছরই মুক্তবাণিজ্য এলাকা স্থাপন করতে চায় সরকার

রাজধানী ঢাকাসহ ৮ জেলায় বজ্রপাতের সতর্কতা জারি

সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে আহত হলেন ইউএনও-ওসি

মেহেরপুরে ভবনের ছাদ ধসে স্বামীর মৃত্যু, আহত স্ত্রী

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় এবার সামরিক মহড়া চালালো পাকিস্তান

শ্রমিকদের গায়ের ঘাম আতরের মতো লাগে: জামায়াত আমির

ফ্যাসিবাদী আ.লীগকে প্রতিহত করতে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন: রিজভী

দেশের গ্যাস খাতের সব দেনা শোধ করলো পেট্রোবাংলা

নাফ নদী থেকে ৪ জেলেকে ধরে নিয়ে গেল আরাকান আর্মি

শ্রমিকের উন্নয়ন ছাড়া নতুন বাংলাদেশ সম্ভব নয়: প্রধান উপদেষ্টা

যেসব ফল শরীরের ওজন বাড়ায়

আইনের শাসনই রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড

জাগ্রত ছাত্র জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার পথরেখা

নীতিনির্ধারকরা কলকারখানার মালিক হওয়ায় শ্রমিকেরা অধিকার বঞ্চিত

শাহ আমানত দিয়ে শিগগির কার্গো ফ্লাইট চালু হবে: বেবিচক চেয়ারম্যান

মহান মে দিবস অমর হোক শ্লোগানে মুখরিত রাজপথ

শ্রমিক-মালিক এক হয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস

ছয় গোলের থ্রিলারে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে বার্সার নাটকীয় ড্র