হালাল পণ্যের বৈশি^ক বাজার এখন তিন ট্রিলিয়ন ডলারের, যা আগামী ১০ বছরের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৯ ট্রিলিয়নে উন্নীত হতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। অথচ এই বাজারে বাংলাদেশ একেবারেই অনুজ্জ্বল। মাত্র ৮৫০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি, তাও শুধু কৃষিপণ্য। এর বাইরে ইসলামিক বিনিয়োগ, লাইফস্টাইল পণ্য, কসমেটিকসের যে বাজার, সেখানে উপস্থিতি নেই বাংলাদেশের।
গতকাল শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের হালাল শিল্প খাতের উন্নয়ন: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় এসব তথ্য উঠে আসে। এ সময় হালাল পণ্যের বাজার নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মমিনুল ইসলাম।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈশি^ক বাজারে ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ ইসলামিক ফাইন্যান্স, ২০ দশমিক ৬ শতাংশ হালাল খাবার, ১০ শতাংশ লাইফস্টাইল পণ্য এবং ২ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে হালাল কসমেটিকসের দখলে। এই বাজারে হালাল খাদ্য এবং মাংসের বৈশি^ক বাজারে ব্রাজিলের ব্যবসা ৫ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের, অস্ট্রেলিয়ার ২ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন এবং ভারতের ২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের। এর বাইরে হালাল কসমেটিকসের বাজার এখন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স এবং জার্মানির দখলে। অথচ বিশ্বব্যপী হালাল পণ্যের বাজার বাড়লেও মূল বাজারটি এখনো ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এর আওতাধীন দেশগুলো।
গবেষকরা বলছেন, হালাল পণ্যের বাজার দ্রুত বাড়ছে। এই বাজার ২০২৮ সালের মধ্যে ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। হালাল পণ্যের বাজার প্রতি বছর ৭ দশমিক ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
ঢাকা চেম্বারের অনুষ্ঠানে সংগঠনটির ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে হালাল পণের বৈশ্বিক বাজার প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের হলেও বাংলাদেশের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারেরও কম। একটি কার্যকর হালাল ইকোসিস্টেমের অনুপস্থিতির পাশাপাশি দেশে হালাল পণ্যের অ্যাক্রিডিটেড সার্টিফিকেট প্রদানে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ না থাকার কারণে এ খাতের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
অবশ্য মূল প্রবন্ধেও হালাল পণ্যের বাজারে পিছিয়ে থাকার কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সার্টিফিকেশন ইস্যু করার দুটি কর্তৃপক্ষ, সীমিত অ্যাকাডেমিক এনগেজমেন্ট, গতানুগতিক শিল্পের বাইরে না যাওয়া, হালাল পণ্য উৎপাদনের এসএমই প্রতিষ্ঠান না থাকা, দেশের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং না থাকা, কোম্পানিগুলোর প্রোমেশনাল কার্যক্রমে ঘাটতি এবং জাতীয়ভাবে হালাল নীতি না থাকাই এই পিছিয়ে পড়ার কারণ। একই সঙ্গে এর জন্য সচেতনতা নেই, সাপ্লাই চেইন না থাকা, দক্ষ মানবসম্পদের অভাবও এর জন্য দায়ী।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী বলেন, ২০৩৪ সালে হালাল পণ্যের বাজার ৯ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, অথচ বাংলাদেশ মাত্র ৮৫০ মিলিয়ন ডলারের হালাল পণ্য রপ্তানি করে, যার বেশির ভাগই কৃষিভিত্তিক পণ্য। হালাল শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও, বাংলাদেশের সামনে একাধিক কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ থাকায় এ খাতের বিকাশ কাক্সিক্ষত মাত্রায় পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তিনি বলেন, হালাল পণ্যের আন্তর্জাতিক মান বজায় না রাখা, লজিস্টিক অবকাঠামোর স্বল্পতা, শুল্কহার ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তির জটিলতা, আধুনিক পরীক্ষাগারের অপ্রতুলতা, দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তির অভাবসহ সার্বিকভাবে হালাল ইকোসিস্টেম না থাকার বিষয়টি এ খাতের কাক্সিক্ষত উন্নতিতে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। দেশের হালাল সার্টিফিকেটের বৈশ্বিক স্বীকৃতি প্রাপ্তির লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র বোর্ড গঠন করা একান্ত অপরিহার্য।
বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডের মহাপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর মহাপরিচালক (যুগ্ম-সচিব) মো. আরিফুল হক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর মহাপরিচালক বেবী রাণী কর্মকার, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)’র উপ-পরিচালক (হালাল সার্টিফিকেশন) এস এম আবু সাইদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক ড. মো. আবু সালেহ পাটোয়ারী, বেঙ্গল মিটের হেড অব সাপ্লাইচেইন এজিএম সায়েদুল হক ভূইয়্যা, মেটামরফোসিস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিক এম আলম এবং প্যারাগন গ্রুপের সহকারী ম্যানেজার (এক্সপোর্ট) মো. আবুল কালাম আজাদ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ইপিবি’র মহাপরিচালক বেবী রাণী কর্মকার জানান, হালালের বৈশ্বিক বাজার প্রতিবছর প্রায় ১২ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সম্ভাবনাময় এ খাতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়াতে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।
বিডা’র মহাপরিচালক মো. আরিফুল হক জানান, এলসিডি পরবর্তী সময়ে রপ্তানি সম্প্রসারণে সম্ভাবনায় হালাল খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। হালাল খাতের উন্নয়নে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।
আমার বার্তা/এল/এমই