
কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার জেলেপল্লী জুড়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। জীবিকার তাগিদে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কারাগারে বন্দি হয়ে আছেন এখানকার ৫৫ জন জেলে। পরিবারের সদস্যরা প্রতিক্ষায় পথ চেয়ে আছেন কবে ফিরবেন তাদের স্বজনরা।
বাংলাদেশের জলসীমা অতিক্রম করে ভুলবশত ভারতে ঢুকে পড়ায় গত ১৪ দিনে তিন দফায় তিন ট্রলারসহ এসব জেলেদের আটক অরে দেশটির উপকূলীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী কোস্টগার্ড।
>> যেভাবে আটক হলেন জেলেরা
সর্বশেষ গত ৩০ নভেম্বর রাতে পশ্চিমবঙ্গ উপকূলীয় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভারতীয় কোস্টগার্ড কুতুবদিয়া থেকে বঙ্গোপসাগরে যাওয়া ‘এম.বি. আল্লাহ মালিক’ নামে একটি ট্রলারসহ ১৫ জন জেলেকে আটক করে।
তারা হলেন- কুতুবদিয়া উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক, বেনু বাঁশি জল দাশ, ফয়েজ, মোস্তাক আহম্মদ, নাজিম উদ্দীন, সর্বানন্দ জল দাশ, সম্রাজ দাশ, মো. কাইছার, নিবজল দাশ, আব্দুস ছালাম, আইয়ুব খান, আব্দুল আলিম, শিপংকর দাশ, শামীম উদ্দিন ও লিবজল দাশ।
ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলা হয়েছে- আটক জেলেদের ট্রলারটিসহ পশ্চিমবঙ্গ ফ্রেজারগঞ্জ পুলিশের কাছে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে হস্তান্তর করা হয়েছে।
উপজেলার কৈয়ারবিলের বাসিন্দা নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন ট্রলারে থাকা ২৮ জেলেকে গত ১৯ নভেম্বর একইভাবে আটক করা হয়।
নজরুল ইসলাম বলেন, সমুদ্রে কুয়াশার কারণে পথ ভুলে সমুদ্রসীমা অতিক্রম করে ভারতে চলে গেলে তারা সেখানকার কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়ে।
ওই ট্রলারটিতে থাকা জেলেরা হলেন- দক্ষিণ ধূরুং ইউনিয়নের জসিম উদ্দিন, নুরুল বশর, মোহাম্মদ শাহিন, তারেক মুহাম্মদ নওশাদ, আতিকুর রহমান, শাহাব উদ্দিন, মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, মোহাম্মদ রাকিব, মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, নুরুল ইসলাম, জোবাইদুল হক, আলী আকবর, ডেইল ইউনিয়নের জকির আলম, জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ তুহিন আলম, মোহাম্মদ মোজাহেদ, শাহেদুল ইসলাম, মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, উত্তর ধূরুং ইউনিয়নের হাফিজুর রহমান, আবুল বশর, মোহাম্মদ নাজেম উদ্দিন, এনামুল হক, মোহাম্মদ শরীফ, রবিউল হাছান এবং কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ওমর ফারুক, মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম, আকতার হোছাইন, নজরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলী।
গত ১৯ নভেম্বর মাঝসাগরে ইঞ্জিন বিকল হলে বিপাকে পড়ে বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখীল এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন ট্রলার ‘এম. ভি মায়ের দোয়া’।
জাহাঙ্গীর জানান, কারিগরি ত্রুটিতে পথ ভুলে ভারতের দিকে চলে যায় ‘এম. ভি মায়ের দোয়া’, যেখানে কুতুবদিয়ার ১৩ জনসহ ২৬ জেলে ছিলেন।
কুতুবদিয়ার ১৩ জেলে হলেন- ছৈয়দ নুর, মামুনুর রশীদ, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মো. মারুফুল ইসলাম, মো. মিরাজ উদ্দিন, মো. ফারুক, মো. একরাম, শওকত আলম, সরওয়ার হোছাইন, আজিজ হোসাইন, নুর মোহাম্মদ, আবু তাহের ও রেজাউল করিম।
তাদের আটকের পর ফ্রেজারগঞ্জ পুলিশের হাতে তুলে দেয় ভারতীয় কোস্টগার্ড। পরবর্তীতে কাকদ্বীপ মহকুমা আদালতের মাধ্যমে সেখানকার কারাগারে পাঠানো হয় বলে জানান জাহাঙ্গীর।
>> অপেক্ষায় পরিবার, ফেরত পেতে সরকারের কাছে আকুতি
বড় ছেলে মারা যাওয়ার মেজো ছেলে শিপংকর দাশ পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। ছেলের হঠাৎ এমন পরিণতিতে দুশ্চিন্তায় পড়া মা নয়ন রানী দাশ বলেন, আমার ছেলেটা খুব ভালো। বড় ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে ৬ জন সদস্যের ঘরকে সে একাই সামলাচ্ছিল, চিন্তায় আছি জানি না কবে আমার বাবুটার চেহারা দেখব।
বেনু বাঁশি জল দাশের স্ত্রী বিপু রানী স্বামী আটকের খবরে পাগলপ্রায়। তিনি বলেন, স্বামী ছাড়া আমার ঘর আঁধার হয়ে আছে , আমি তাকে ফিরে পেতে চাই। সে শারীরিকভাবে অসুস্থ তারপরেও সাগরে গিয়েছিল আমাদের কথা ভেবে।
কূটনীতিক তৎপরতায় নিজের সন্তানসহ আটকদের ফেরত আনতে সরকারের উচ্চমহলের দ্রুত পদক্ষেপ চান জেলে মোহাম্মদ রফিকের বাবা এনামুল হক। তিনি বলেন, সরকার চাইলে ভারতের সাথে যোগাযোগ করে রফিকসহ অন্যদের ফিরিয়ে আনতে পারে। আমাদের দাবি দ্রুতই তারা যেন ফিরে আসে, এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
>> যা বলছে প্রশাসন
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আটক জেলেদের তালিকা পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ ধূরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আজাদ।
তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নসহ পুরো উপজেলার যেসব জেলেরা ভারতে বন্দি আছেন তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। সবাই মাছ ধরে আয় রোজগার করেন আর তাতেই তাদের পরিবার চলে। এখন পরিবারগুলো কষ্টে আছে আমরা চাই তারা মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসুক।
কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্যথোয়াইপ্রু মারমা জানান, প্রশাসন এ বিষয়ে অবগত হয়ে কাজ করছে। তালিকা প্রণয়নের পাশাপাশি আটক জেলেদের পরিচয় নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
সম্প্রতি কুতুবদিয়া সফরে এসে আটক জেলেদের মধ্যে কয়েকটি পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান।
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন আটক জেলেদের পরিবারগুলো খোঁজখবর রাখছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে, আমাদের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব সহযোগিতা করা হবে যেন তারা ফিরে আসেন।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের গত ২ জানুয়ারি বাংলাদেশের ৯০ জেলেকে মুক্তি দেয় ভারত। একই দিনে ৯৫ জন ভারতীয় জেলেকে সেদেশের কোস্টগার্ডের হাতে ফেরত দেয় বাংলাদেশ।
পারস্পরিক মুক্তি ও প্রত্যাবাসন অভিযানের আওতায় এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় জানিয়ে সে সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মানবিকতা এবং উভয় দেশের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের উদ্বেগের কারণগুলো বিবেচনায় রেখে এই বিনিময় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।
আমার বার্তা/জেএইচ

