বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নতুন ভিসির দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই কমতে শুরু করেছে তেলবাজদের দৌরাত্ম্য। সাবেক ভিসির প্রকাশ্য তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা তেলবাজ সিন্ডিকেট এখন আত্মরক্ষার্থে গা ঢাকা দিয়েছে। ফলে অফিস কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা ফিরেছে এমনটাই জানালেন বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মরত চিকিৎসকরা।
তাদের মতে নতুন ভিসি দায়িত্ব নিয়েই প্রথমে তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কিছু অনিয়মের লাগাম টেনে ধরেছেন। বিশেষ করে দালাল চক্র আর তেলবাজদের বিরুদ্ধে তিনি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন। যা তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর দিন থেকেই বাস্তবায়ন করেছেন। বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ একই সঙ্গে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে তিনি জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ নেন। গৃহীত পদক্ষেপ তিনি বেশ সফলভাবেই বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। এসময় তিনি ছবি প্রদর্শন ও দলাদলির বিরুদ্ধে নিজের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দেন। সেই সঙ্গে স্পষ্ট করেন এখানে ছবি প্রদর্শন আর দলাদলির কোনো স্থান নেই। তিনি তার মেয়াদকালে এই ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড বরদাশত করবেন না বলে জানিয়ে দেন।
তেলবাজদের বিরুদ্ধে অবস্থান: সদ্য সাবেক ভিসির প্রছন্ন সমর্থনে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনে একটি নতুন চক্র গজিয়ে ওঠেছে স্থানীয়দের ভাষায় তেলবাজ বলে চিহ্নিত। নতুন ভিসি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই তিনি এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেন। তার সুফলও মিলেছে। দিনের দাপট দেখানো চক্রটি নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ভিসির স্পষ্ট ঘোষণা যেকোনো ভালো কাজে তিনি যেমন সমর্থন দেবেন তেমনি খারাপ কাজকে তিনি সমানভাবে ঘৃণা করেন। তার কাছে তোয়াজকারীদের কোনো ঠাঁই নেই। তাইতো তিনি এই চক্রের বিরুদ্ধে নিজের কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। তেলবাজ বা তোয়াজকারীদের বিরুদ্ধে আরোপ করেছেন বিভিন্ন ধরনের বিধি নিষেধ।
যার ভিতরে রয়েছে কার্যালয়ের অভ্যন্তরে তাদের অবাধ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ একই সঙ্গে সবধরনের অনৈতিক সুপারিশ বন্ধ। চক্রটি সাবেক ভিসি ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে একধরনের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেন। তাদের কাজই ছিল দায়িত্ব পালন না করে সর্বদায় ভিসি সাহেবের গুণকীর্তন করা। এমন ঘটনাও ঘটেছে চক্রটি ভিসিকে তেল মারতে তাকে বিভিন্ন সময়ে রিসিভ করতে ব্যস্ত থাকতেন। এসময় লাইনে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষমান রোগীদের চিকিৎসা না দিয়ে তারা ভিসিকে সম্মাননা দিতে প্রধান গেটে দুই লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অনেক সময় লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়ার মতো ভিসিকে রিসিভ করে তার কার্যালয়ে পৌঁছে দিতেন। যা সরকারি চাকরির নিয়ম বিধির যেমন লঙ্ঘন তেমনি চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের জন্য বিড়ম্বনার কারণ।
ব্যানার ফেস্টুন অপসারণ : নতুন ভিসি দায়িত্ব নিয়ে তার নৈতিকতা বোধ থেকে অপসারণ করেছে ভার্সিটির প্রধান গেট থেকে আশপাশে টাঙ্গানো বিভিন্ন ধরনের ব্যানার আর ফেস্টুন। এসব ব্যানারে সাবেক ভিসি শারফুদ্দিন আহমেদের ছবি পত পত করে উড়তে দেখা যেত। চক্রটি ছবি ঝুলিয়ে নিজেরা লাভবান হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলা করেছে তারপরেও প্রাক্তন ভিসির আশীর্বাদে পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়ে সরকারকে বিতর্কিত করেছে।
কোলাহল মুক্ত ক্যাম্পাস : সাবেক ভিসির আমলের সেই কোলাহল আর হৈচৈ বন্ধ করতে নতুন ভিসি পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি সকলকে দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি হৈচৈ, আড্ডা, কোলাহল মুক্ত একটি পরিবেশ উপহার দিয়েছেন। নতুন ভিসির নির্দেশে ব্যক্তিগত সব ব্যানার ফেস্টুন অপসারণ করা হয়েছে। ছিমছাম পরিবেশে বর্তমানে রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করেছেন। এদিকে ফাইল আটকে রাখার কালচার বন্ধ করেছেন। বর্তমানে ফাইল এলে প্রসিডিউর মতো কোনো ঝামেলা ছাড়াই সেটির ফয়সালা করা হচ্ছে। তাই থমকে থাকা উন্নয়নে নতুন করে গতির সঞ্চার হয়েছে।
নতুন ভিসির অর্জন : বিএসএমএমইউ প্রশাসন ভবন থেকে একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বর্তমান ভিসির যোগদানের এক মাসের ব্যাবধানে সব কিছু পরিবর্তন শুরু হয়েছে। কাজ বন্ধ করে তাকে রিসিভ করতে কেউ যাতে দাঁড়িয়ে না থাকে তার জন্য অলিখিত কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। আর দলবেধে বিএসএমএমইউ ভিসির কার্যালয়ে আড্ডা, কাজ ভাগিয়ে নেয়া, তেলবাজি করার কোনো সুযোগ নেই। সব কিছুই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলছে।
অভিযোগ রয়েছে, আগে কোন কোন কর্মকর্তা ভিসির নাম ব্যবহার করে কেবিনে রোগী ভর্তি করে টাকা নিত বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন তা করতে অনেকেই সাহস পান না। কারণ, নতুন ভিসি নিজে সবধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। এখন রোগীদের সেবার মান আগের চেয়ে অনেকটাই উন্নত হয়েছে।
স্পেশালাইজড হাসপাতাল এবং তার পরিণতি: সাবেক ভিসির আমলে ভার্সিটির সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠে। যার কারণে সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশ্বমানের করার কথা থাকলে তা মুখ থুবড়ে পড়ে। বর্তমান ভিসির আমলে সেটি নতুন করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিগগিরই স্পেশাল হাসপাতালের জরুরি বিভাগ চালু করা হবে। এই লক্ষ্যে জোরেশোরে কাজ চলছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিএসএমএমইউ’র কিছু দলবাজ কর্মকর্তা কাজ না করে কর্মস্থল ও অফিস জুড়ে প্রভাব বিস্তার করে ফায়দা লুটছে। তাদের চেষ্টা নিজেদের পকেট ভরা। এসব কর্মকর্তা আর প্রভাবশালীদের স্বার্থহানি হলেই তারা বেঁকে বসছে। আবার প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নিজেদের স্বার্থের বাইরে গেলেই তারা বিএনপি-জামায়াত বলে প্রচার করছেন। এই ধরনের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে। যারা বিশেষ জেলার হলেই অন্যকে ধমক দিতে দ্বিধাবোধ করেনি। তবে বর্তমান ভিসির কারণে তাদের অনেকেই এখন চুপ মেরে গেছেন।
যেসব যায়গায় পরিবর্তন ঘটেনি: একটি সূত্র বলছে, বিএসএমএমইউ সব কিছুতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও কেন্টিনগুলোর খাবারের মান এখনও উন্নত হয়নি। কেন্টিনের পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর ও অস্বত্বিকর। লুচি, পুরি ও পরটা ছাড়া সেখানে মানসম্মত নাস্তা বা খাবার মেলেনা। ক্যান্টিনের টেন্ডার নিয়ে সমালোচনা রয়ে গেছে। ক্যান্টিনগুলো নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা মন্তব্য করেছেন। এদিকে ভার্সিটির টিএসসির বন্ধ ক্যান্টিন নতুন করে চালু করায় গরমে অফিসে বসাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এতে বি-ব্লকের নিচ তলা, দোতলা ও তৃতীয় ও চতুর্থ তলার গরমে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
কী বলছেন অন্যরা: বিএসএমএমইউ প্রক্টর ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বর্তমান বিএসএমএমইউ’র পরিস্থিতি এখন পুরো শান্ত। তেলবাজি ও দলবাজরা গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছে। বেড়েছে রোগীর সেবার মান। বিএসএমএমইউ উন্নয়ন নিয়ে এখন কাজ চলছে।
এদিকে ভার্সিটির নতুন ভিসি দীন মো. নুরুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তাই তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, গত ১১ মার্চ বর্তমান ভিসি দীন মো. নুরুল হককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়। গত ২৯ মার্চ শুক্রবার হওয়ায় তিনি আগের দিন ২৮ মার্চ ভিসি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। গতকাল ২৮ এপ্রিল তার এক মাস পূর্ণ হয়েছে। গত এক মাসে জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের স্থবিরতা কেটে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে। এখন ভিসি একাই বিভাগ গুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা সরজমিনে পরিদর্শন করেন বলে ডাক্তারা জানিয়েছেন। এটি বর্তমান ডিসির নতুন পদক্ষেপ বলে জানালেন চিকিৎসকরা।
আমার বার্তা/এমই