জাতীয় রাজনীতিতে একটি সুস্পষ্ট মেরু পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন একে অপরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সহযোগিতার মাধ্যমে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতের পথ হঠাৎই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। নির্বাচনি প্ল্যাটফর্মে যাত্রা শুরু হলেও, সনদ স্বাক্ষর ইস্যুতে দল দুটি একমত না হওয়ায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিক্ততার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন দাবিতে একে অপরের সঙ্গে মিল রেখে কাজ করেছিল এনসিপি ও জামায়াত। অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে উভয় দল সমান্তরাল পথে হেঁটেছে এবং নানা ইস্যুতেও সহ-অবস্থান বজায় রেখেছে। তবে জুলাই সনদ যেন দুই দলের মধ্যে বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। জামায়াত সনদে স্বাক্ষর করলেও এনসিপি তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
স্বাক্ষর সংক্রান্ত পরিস্থিতি খুবই নাটকীয় ছিল। সনদ স্বাক্ষরের আগের দিন এনসিপি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে। একই দিনে জামায়াত জানায় তারা স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেবে, তবে স্বাক্ষর করবে কি না তা সময় দেখাবে। পরদিন জামায়াতের নেতারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং স্বাক্ষরও করেন। এনসিপির পক্ষ থেকে জামায়াতের এই পদক্ষেপকে ‘বেঈমানি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. রইস উদ্দিন বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হয়েছে। দেশের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত থাকা উচিত। দীর্ঘ সময় জনগণ তাদের পছন্দের প্রতিনিধিকে ভোটের মাধ্যমে বেছে নিতে পারেনি। তাই ফেব্রুয়ারিতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে সকল শক্তিকে এক থাকতে হবে। বিশেষ কোনো দলের স্বার্থ নয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে একত্রিত করা জাতির জন্য কল্যাণকর।”
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্যের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে, তারা গণঅভ্যুত্থান ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জামায়াতের চালু করা ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) আন্দোলন’ ছিল একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা। এটি জাতীয় সংলাপকে কেন্দ্রীয় সংস্কারের আলোকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা এবং জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো নিশ্চিত করা, কিন্তু তা হাইজ্যাক হয়েছে।”
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, “রাজনৈতিক দলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক। এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যেও পূর্বের মতোই সম্পর্ক আছে। মিডিয়া যে ফ্রেমিং করেছে, তা বাস্তবতার সম্পূর্ণ প্রতিফলন নয়।”
সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন মন্তব্য করেন, “জামায়াত কোনো গণমানুষের দল নয়। আমরা তাদের এবং আওয়ামী লীগকে এক মুদ্রার দুইপিঠ হিসেবে দেখেছি।”
অন্যদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “এনসিপির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগের মতোই আছে। জোটের সম্ভাবনা আছে কি না তা সময় দেখাবে। জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারীদের ‘পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড’ হিসেবে আমরা বিষয়টি দেখছি।”
অন্য সহকারী সেক্রেটারি আব্দুল হালিম জানান, “এনসিপি জুলাই অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। স্বাক্ষরের মাধ্যমে যদি আমাদের সঙ্গে একমত হত, তবে তা সবার জন্যই ভালো হতো। তবে এসবের কারণে আমাদের সম্পর্কের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।”
উল্লেখ্য, ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। তবে এনসিপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) এবং বাংলাদেশ জাসদের নেতারা অনুষ্ঠান ও স্বাক্ষরে অংশ নেননি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাকি দলগুলোরও স্বাক্ষরের আহ্বান জানিয়েছেন।
আমার বার্তা/এল/এমই