শিক্ষা জাতির অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন আজ বারবার অস্থিরতায় কাঁপছে। যে বিশ্ববিদ্যালয়, যে কলেজ কিংবা যে স্কুল হওয়ার কথা জ্ঞানচর্চার নিরাপদ আশ্রয়, সেটিই প্রায়শই রূপ নিচ্ছে সংঘাত ও সহিংসতার অঙ্গনে। এ অস্থিরতা কেবল শিক্ষার্থীর জীবনকে ব্যাহত করছে না; বরং জাতির ভবিষ্যৎ ও উন্নয়নকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংগঠনের দ্বন্দ্ব, হলে দখলবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ কিংবা ক্ষমতার লড়াইয়ের দৃশ্য এখন আর নতুন নয়। অনেক ক্ষেত্রে এই সহিংসতা প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। কলেজ পর্যায়ে ক্লাস বন্ধ, হরতাল কিংবা অনিয়মিত পরীক্ষা শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনকে অনিশ্চিত করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দেখা যায় বাণিজ্যিকীকরণ, কোচিং নির্ভরতা ও অতিরিক্ত চাপের প্রভাব। সব মিলিয়ে শিক্ষাঙ্গন জুড়ে যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তা শান্তিপূর্ণ শিক্ষা জীবনের সঙ্গে যায় না।
কেন এই অস্থিরতা? কারণগুলো বহুমাত্রিক। প্রথমত, ছাত্ররাজনীতি তার মৌলিক লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে দলীয় স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হয়েছে। একসময় ছাত্ররাজনীতি ছিল অধিকার আদায়ের, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা বিকাশের এবং সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার। কিন্তু বর্তমানে এটি তার আদর্শিক লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ সরে এসেছে। ছাত্রসংগঠনগুলো এখন আর শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য কাজ করে না, বরং দলীয় ক্ষমতার দণ্ডমুণ্ড হয়ে উঠেছে। হল দখল, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, এবং নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য অন্য সংগঠনের সঙ্গে সংঘাত এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই ধরনের রাজনীতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে এবং তাদের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ক্ষমতা ও অর্থের লোভ ছাত্রনেতাদের মধ্যে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে, যার ফলস্বরূপ ক্যাম্পাসে প্রায়ই সংঘর্ষ ও মারামারি ঘটে।দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা—মুখস্থ নির্ভর পাঠ্যক্রম ও গবেষণার অভাব শিক্ষার্থীদের হতাশ করে। তৃতীয়ত, সেশনজটের কারণে শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হয়; চাকরির বাজারে প্রবেশ দেরি হয়। তার ওপর কর্মসংস্থানের ঘাটতি নতুন সংকট সৃষ্টি করে। আরেকটি বড় কারণ হলো শিক্ষাঙ্গনে দখলবাজি ও সন্ত্রাসের সংস্কৃতি। প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দলীয় প্রভাবের কারণে এগুলো রোধ করা যায় না। প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীর জীবনে। তাদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়, মানসিক চাপ বাড়ে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার মান নষ্ট হয়; শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে পারেন না। তৃতীয়ত, মেধা পাচারের হার বাড়ছে—মেধাবীরা নিরাপদ পরিবেশের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাব পড়ে রাষ্ট্রের ওপরও। একটি অস্থির শিক্ষাঙ্গন থেকে সুস্থ নেতৃত্ব জন্ম নেয় না; বরং সমাজেও ছড়িয়ে পড়ে অস্থিরতার সংস্কৃতি।
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ অস্থির হয়েছে উঠেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। এ ছাড়া নানা ইস্যুতে বুয়েটসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাঙ্গনে বিরাজমান এসব উত্তেজনার কারণে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত এক বছরে অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষকসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। মব করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত আড়াই হাজার শিক্ষককে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ, বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধসহ টানা আন্দোলন আর শিক্ষকদের শারীরিক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘিরে এ সময় উত্তাল ছিল দেশের শিক্ষাঙ্গন। গত বছর সচিবালয়ে ঢুকে এইচএসসি পরীক্ষার ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করানো এবং তাদের অটোপাস আদায়; সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালেও অটোপাস চেয়েছিল শিক্ষার্থীরা। অবশ্য সরকার তাতে সায় দেয়নি। এক বছরে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তত ২৬টি সংঘর্ষ, ৯টি আন্দোলন এবং ৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বিভিন্ন দাবিতে অন্তত ১২০টি আন্দোলন করেছে দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল কলেজগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বেশ কিছু আলোচিত ঘটনা, যা শিক্ষাঙ্গনে একাডেমিক ও প্রশাসনিক নাজুকতারই সাক্ষ্য বহন করে।
সর্বশেষ গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা এ দুর্বলতারই ধারাবাহিকতা। এর মধ্যে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানজুড়ে সংঘর্ষ, অবরোধ ও আন্দোলনের ঝড় বইছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচন ঘিরে তুলকালাম, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনশন-হুঁশিয়ারি, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেলপথ অবরোধ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সর্বাত্মক শাটডাউনসহ শিক্ষক সংগঠনের মহাসমাবেশে একাধিক দাবিতে সরব শিক্ষাঙ্গন। উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য অন্যতম দায়ী হিসেবে সংশ্লিষ্টরা গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়াকে দায়ী করছেন। পাশাপাশি অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বা শিক্ষার জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করা এবং এ বিষয়ে সরকারের উদাসীনতাকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য তো রয়েছেই; এ অঙ্গনে কোনো ধরনের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা লক্ষ করা যায়নি। ফলে বেড়েছে হতাশা। যার ফল আজকের অস্থিরতা ও উত্তেজনা।
এসকল অস্থিরতা দূর করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ছাত্ররাজনীতির সংস্কার। রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, তবে তা হতে হবে গণতান্ত্রিক ও ইতিবাচক। বিতর্ক, মতবিনিময়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও সমাজসেবার মধ্য দিয়ে ছাত্ররা নেতৃত্ব শিখুক।শিক্ষাব্যবস্থাকে সময়োপযোগী করতে হবে। মুখস্থ নির্ভর পরীক্ষার বদলে গবেষণামুখী, দক্ষতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে; ভর্তি থেকে শুরু করে হল ব্যবস্থাপনা—সবখানেই জবাবদিহি থাকতে হবে।সেশনজট নিরসনে কঠোর একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ জরুরি। একইসঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। শিল্প, বাজার ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে যাতে শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষে অনিশ্চয়তায় না পড়ে।পরিবার ও সমাজকেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। শিক্ষার্থীর ওপর অতিরিক্ত প্রত্যাশা চাপিয়ে না দিয়ে তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করা দরকার।
অস্থির শিক্ষাঙ্গন মানেই অস্থির সমাজ। তাই শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ফিরিয়ে আনা এখন জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন। শিক্ষা হতে হবে আলোর উৎস, সহিংসতার নয়। এই কাজের দায়িত্ব এককভাবে কারো নয়; সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীর সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া কোনো সমাধান সম্ভব নয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার বার্তা/সাদিয়া সুলতানা রিমি/এমই