পাহাড়, ঝরনা আর সবুজের প্রাচুর্যে ভরা সিলেটে ছড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সব পর্যটনকেন্দ্র। সবুজে মোড়া পাহাড়ের কোলঘেঁষা পাথুরে নদী, বন, ঝরনা, চা-বাগান কী নেই এখানে! সিলেটের বৈচিত্র্যে ভরা সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসেন পর্যটক আর ভ্রমণপ্রিয় মানুষ।
আমরা পাঁচ বন্ধুও ঠিক করলাম দুটি পাতার একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট ভ্রমণে যাবো। পাঁচজনের একজন মো. সাজ্জাদ হোসাইন থাকে নারায়ণগঞ্জ মাতুয়াইলে। জালাল থাকে কুমিল্লা আর আমরা তিনজন ঢাকায়।
দুই রাত একদিনের প্লান। এক রাতে যাবো, আরেক রাতে ফেরত আসবো আর একদিনে সিলেটের কয়েকটি স্পট ঘুরে দেখবো। সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে তিন থেকে চার দিন সময় প্রয়োজন। একটা স্পট থেকে আরেকটা বেশ দূরের।
আমরা পাঁচ বন্ধু প্ল্যান করলাম এক দিনে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দর্শনীয় স্থান কাভার করার। তারমধ্যে আমরা তিনটি স্পট চয়েজ করলাম। প্রথমেই দেখবো সিলেটের চা বাগান, এরপর দেখবো দেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন রাতারগুল, মেঘ-পাথর-জল-পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাদা পাথর এবং হযরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরাণের (রহ.) মাজার।
চা বাগান
টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ এ সিলেট। এটাও সিলেটের এক নাম। এ নামে সিলেটকে চিহ্নিত করার পেছনেও যথেষ্ট কারণ ও যুক্তি রয়েছে। যেমন- সিলেটের সর্বত্র বিশেষ করে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সদর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে দেড় শতাধিক চা বাগান।
কয়েক লাখ একর জায়গার এ চা-বাগানগুলোতে দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ চা উৎপন্ন হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত চা বিদেশে রপ্তানি হয়, আয় হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এ চা-পাতা উৎপাদিত হয় দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ি থেকে।
সাধারণত নিচু জায়গা হতে তুলনামূলক উঁচু সমতল ভূমি এবং ছোট আকারের টিলা ও তার পাদদেশে চা গাছ জন্মায়। চা গাছের চারা রোপণ করার প্রায় পাঁচ বছর পর থেকে উৎপাদন শুরু হয়। চা গাছকে কেটে চার-পাঁচ ফুটের মধ্যে রাখা হয়। কারণ এর চেয়ে বড় হলে তা থেকে ভালো ফলন হয় না এবং পাতা সংগ্রহও কঠিন হয়ে যায়।
বর্ষাকালে চা গাছে নতুন কুঁড়ি ও পাতা জন্মালে খুব সুন্দর ও মসৃণ দেখায়। মনে হয়, এক বিরাট সবুজ গালিচা দিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা আচ্ছাদিত করে রাখা হয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু কিছু বড় গাছ থাকে যা চা গাছকে রোদের প্রখরতা থেকে রক্ষা করে। কড়া রোদ আবার চা গাছের জন্য ক্ষতিকর।
রাতারগুল
রাতারগুল জলাবন বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যা সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত। বনের আয়তন ৩ হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর, আর এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এটি পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি জলাবনের মধ্যে অন্যতম একটি। এটি বনবিভাগের অধীনে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখানে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ। বর্ষাকালে এই বন ২০-৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। বাকি সারা বছর, পানির উচ্চতা ১০ ফুটের মতো থাকে।
সাদা পাথর
ধলাই নদ পাড় হয়ে বালুপথ মাড়িয়ে সামনে এগোতেই চোখে পড়ে নিরেট পাথররাজ্য। পাথর ছুঁয়ে ধেয়ে নামছে পাহাড়ের স্বচ্ছ জল। বিশাল এলাকাজুড়ে দুদিকে নিরেট পাথররাজি আর মধ্যে স্বচ্ছ জল। মেঘালয় পাহাড়ের ওপর মেঘের আলিঙ্গন। এ যেন প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য সাদা পাথর। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের ক্যানভাস। এটি সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে অবস্থিত।
রাজধানী সায়েদবাদ থেকে আমাদের ট্যুরের বাস রাত ১১টায় ছেড়ে যায়। সিলেটে পৌঁছায় সকাল ৮টায়। এরপর আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে সকালে খাবার খেয়ে নেই। সেখান থেকে আমাদের ভাড়া করা বাসে করে চা বাগানে যাই। সেখানে আমরা ৩০ মিনিট চা বাগান সৌন্দর্য উপভোগ করি।
চা বাগানে হই-হুল্লোড় করে ছবি তুলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। চা বাগান থেকে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর দেখার উদ্দেশে আমাদের বাস ছেড়ে যায়। ২ ঘণ্টা যাত্রার পর সেই প্রাকৃতিক দৃশ্য সাদা পাথর দেখে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানে আমরা দুপুরে গোসল, জুম্মার নামাজ, খাওয়া-দাওয়াসহ মোট ৪ ঘণ্টা থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ভোলাগঞ্জ থেকে ট্রলারে করে সাদা পাথর পৌঁছাই। আমরা পাঁচ বন্ধু সাদা পাথর ভ্রমণের লোগোযুক্ত ৫টা গেঞ্জি কিনলাম। সে গেঞ্জি পরে আমরা ৫ বন্ধু হই-হুল্লোড় করে সাদা পাথরে পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে আসা বরফেরশীতল পানিতে গোছল করলাম দীর্ঘক্ষণ।
এরপর আমরা গোছল শেষ করে নামাজ পড়তে মসজিদে যাই। ছোট মসজিদ, জায়গা কম, পর্যটক বেশি। জায়গা পাওয়া খুব কষ্টের। কোন কোন পর্যটককে স্থানীয় প্রশাসনকে দোষারোপ করে কথা বলতে দেখা গেছে।
আরিফুল ও রাইসুল নামে কয়েকজন পর্যটক বলেন, এখানে যে পরিমাণ পর্যটক আসে, প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে পর্যটকবাহী বাস থেকে চাঁদা তুলতে পারে, আর একটি মসজিদ করতে পারে না? আর মসজিদে কার্পেটও বেশি ছিল না যে নামাজে ব্যবহার করা যাবে।
যাইহোক কোনরকম জায়গা পেয়ে নামাজ শেষ করে আমরা আমাদের নির্ধারিত জয় বাংলা রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম।
দুপুরে লাঞ্চের সময় হোটেলে অনেক পর্যটক ভোগান্তিতে পড়েছে। এরমধ্যেও আমরাও ভোগান্তিতে পড়েছি। যখন একটু ভিড় কমেছিল তখন খাওয়ার জন্য আমরা টেবিলে বসে যাই। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেই।
হোটেলের বাইরের বাতাসটা ছিল দারুণ। সবাই মিলে উপভোগ করেছিলাম, সে সময়ের প্রকৃতির আবহাওয়ায় মিশে গিয়েছিলাম আমরা পাঁচ বন্ধু।
ঠিক সাড়ে ৩টায় ভোলাগঞ্জ থেকে আমাদের বাস রাতারগুল যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দেই। সময় লাগেছে অনেকক্ষণ, এই দীর্ঘসময়ে বাসে চারদিকে সিলেটের প্রকৃতির পরিবেশে মিশে গিয়েছিলাম।
সুধু সবুজ আর সবুজ। রাস্তার ধারে সারিবদ্ধভাবে পেয়ারা বাগান আরও কত রকমের ফলের সমাহার ছিল। কত সুন্দর সবুজের ছড়াছড়ি। সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য সিলেটেই ভ্রমণ যথেষ্ট। এরমধ্যেই আমরা রাতারগুল পৌঁছে গেছি। তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি। নৌকা ছিল অনেক কম পর্যটক বেশি।
তুলনামূলকভাবে রাতারগুল যাওয়ার জন্য নৌকার সিরিয়ালে অনেক প্রতিযোগিতায় থাকতে হয়েছিল। এরমধ্যে আমরা পাঁচবন্ধু ডাব কিনে খেলাম একশো টাকা করে। যথারীতি সময়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু আসরের সময়ে নামাজে পড়ে শেষ করলাম। এরপর আমরা রাতারগুল যাওয়ার জন্য নৌকা পেয়ে গেলাম।
এরমেধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি, ছাতা ছিল একটা, আমরা ছিলাম পাঁচজন। জামা কাপড় ভিজে একাকার। মোবাইল প্যান্টের পকেটে থাকায় রক্ষা।
বৃষ্টির মধ্যে আমরা রাতারগুল অর্ধেক ঘুরে নৌকা ঘুরিয়ে চলে এসেছি। তারপর আমরা রাতারগুল থেকে সিলেট শহরের শাহ্ জালাল (রহ.) ও শাহ্ পরান (রহ.) এর মাজার দর্শন শেষ করি। সেখানে কেনাকাটা ও রাতের খাবার সেরে রাত সাড়ে ১০টায় বাসে উঠে বসি ঢাকার উদ্দেশে।
দুই দিনের সিলেট ভ্রমণ নিয়ে শেষ কথা
সময় বাঁচানোর জন্য আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছি শহরে এসে বিকেলে। এছাড়া এত কম সময়ে সিলেটের অধিকাংশ স্পট দেখা সম্ভব নয়। শহরের আম্বরখানা এলাকা থেকে স্পটগুলোতে যাবার জন্য সিএনজি অথবা অটোরিকশা ভাড়া করবেন। জাফলং বা সাদা পাথরে বাস যায়। বাসে গিয়ে দুই দিনে এতগুলো স্পট দেখা সম্ভব হবে কঠিন ব্যাপার। তাই হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে ভ্রমণ করুন।
এবি/ওজি