কমছে জ্বালানি বাড়ছে লোডশেডিং

প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৩, ১০:৫২ | অনলাইন সংস্করণ

  বশির হোসেন খান

  প্রিন্ট ভার্সন

দেশে প্রতিনিয়তই সংকট তৈরি হচ্ছে জ্বালানির তার প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ফলে আবারো বেড়েছে লোডশেডিং।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্যানুযায়ী, চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। 

সূত্র বলছে, সোমবারের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। যদিও কয়লা সংকটে কেন্দ্রটির একটি ইউনিট এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। বড় সক্ষমতার এ কেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে এবং চলমান তাপপ্রবাহে বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়তে থাকলে ৩ থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বর্তমানে দৈনিক ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হচ্ছে।
বিপিডিবির তথ্য বলছে, গতকাল শনিবার সর্বোচ্চ বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ৩৪৯ মেগাওয়াট আর রাতে সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার ৩৩৪ মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী বিপিডিবির এ পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তবে সারাদেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে নিয়োজিত পিজিসিবি বলছে, বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনে বর্তমানে দৈনিক দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে।

সংস্থাটি মূলত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করে। পিজিসিবির ঘণ্টাপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও লোডশেডিংয়ের চিত্র থেকে জানা যায়, গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১টায় লোডশেডিং ছিল আড়াই হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। এরপর গতকাল শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় গড়ে লোডশেডিং হয় প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি।

এ বিষয়ে বিপিডিবি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গরমের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া এবং কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সংকটের পাশাপাশি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কয়লা সংকটের কারণে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পটুয়াখালীর পায়রার ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একটি ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) বন্ধ রয়েছে। বাকি ইউনিটটি কাল সোমবারের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় ইউনিটটি বন্ধ হলে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে বিদ্যমান ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। এ বিষয়ে বিপিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এসএম ওয়াজেদ 
আলী সরদার বলেন, লোডশেডিং কীভাবে কমানো যায় সে বিষয়টি নিয়ে আমরা সার্বক্ষণিক কাজ করছি।

তিনি আরো বলেন, পায়রার বিকল্প হিসেবে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। বিশেষত পায়রায় ২২৫ মেগাওয়াট, ইউনাইটেড ১০০ মেগাওয়াট এবং বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ারের ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া ছোট-বড় সক্ষমতার আরো কয়েকটি কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।

দেশে বিদ্যুতের বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৩ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ বাদে)। আর বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। ৯ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মতো সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এসব সক্ষমতার বেশির ভাগই জ্বালানি সংকটে বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়মিত মেরামতে থাকায় সেগুলোও ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
পিজিসিবি সূত্রে জানা যায়, দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে গ্যাস থেকে সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট, তরলীকৃত জ্বালানি (তেলভিত্তিক) থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট, কয়লা থেকে ২ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট, সৌর ও পানিবিদ্যুৎ থেকে প্রায় ৪৫০ মেগাওয়াট এবং বাকিটা ভারত থেকে আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে।
এদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ায় মফস্বলে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন। ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, ফরিদপুর, বাগেরহাট অঞ্চলে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার গ্রাহকরা। এদিকে গত কয়েকদিনে রাজধানীতেও বেড়েছে লোডশেডিং। ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে (ডিপিডিসি) দৈনিক ৩০০-৪০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। একই বিরূপ পরিস্থিতির কথা জানিয়েছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)।

ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী বলেন, গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেসকো এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ না পাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বর্তমানে ২০০-৩০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং থাকছে। শিডিউল করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি আমরা। ডেসকোর দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ১ হাজার ৪০০-১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। সেখানে বিতরণ কোম্পানিটি সরবরাহ করছে ১ হাজার ২০০-১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট।

গতকাল ডেসকো এলাকায় ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে। এ কোম্পানির পিক টাইম বেলা ২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সংকটকে দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। মূলত কয়লার বিল বকেয়ার কারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিপুল অংকের বিল বকেয়া থাকায় কয়লা সরবরাহে অর্থায়ন বন্ধ করে চীনা কোম্পানি সিএমসি। এ পরিস্থিতিতে এক মাস ধরে কয়লা আমদানির বিষয়ে কোনো সুরাহা করতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। সর্বশেষ পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১ জুন এলসি (ঋণপত্র) খুলেছে সিএমসি। নতুন এ এলসিতে চার লাখ টন কয়লা আসবে দেশে। ইন্দোনেশিয়া থেকে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা আসতে সময় লাগবে ২০-২৫ দিনের মতো। এ কয়লা আসার পর পুনরায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে যেতে পারবে।

বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়লা আমদানি কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেছে সিএমসি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানি সংকটের কারণে চলমান লোডশেডিং আরও কিছু দিন অব্যাহত থাকবে। গরম অনেক বেড়ে গেছে। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রির উপরে চলে গেছে। কোথাও ৪০-৪১ ডিগ্রি হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে কিছুটা লোডশেডিং চলছে। এই কারণে আমরা দুঃখিত। চলমান লোডশেডিং আরও কিছু দিন চলবে। জাতীয় গ্রিডে প্রায় ১৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং চলছে।
কাল সোমবারের পর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত ২৫ মে থেকে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ আছে, দ্বিতীয় ইউনিট আগামী ৫ জুনের পর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ কয়লার অভাব দেখা গেছে এবং সেটা আসতে আরও ২০-২৫ দিন লেগে যাবে। এখানে একটা বড় বিদ্যুৎ আমরা পাচ্ছি না সিস্টেমে। এই কারণে কিছুটা জনদুর্ভোগ হচ্ছে। লোডশেডিং বেড়ে গেছে। তেলের ব্যাপারেও আমরা হিমশিম খাচ্ছি। এখন ইন্ডাস্ট্রিতে বেশির ভাগ গ্যাস ডাইভার্ট করছি।

এবি/ওসমান