সিন্ডিকেট প্রথা ভেঙ্গে সকল বায়রা সদস্যের ব্যবসার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে
প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ
এস আর হাসান চৌধুরী খালেদ:

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানী খাতের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বায়রার জনপ্রিয় নেতা। তার প্রতিষ্ঠান, খাজা গ্রুপ অব কোম্পানিজ। তিনি সততা ও দক্ষতার সাথে বিদেশের শ্রমবাজারে প্রচুর সংখ্যক লোক প্রেরণ করেছেন। তিনি কুমিল্লার কৃতি সন্তান। তার গ্রুপের আরও প্রতিষ্ঠান গুলো হলো : মেট্রোপলিটন ইন্টারন্যাশনাল, খাজা হোল্ডিং কোম্পানি, সবুজের বন্ধন পিএলসি, এছাড়া তিনি অনেক মানবিক একজন মানুষ। এজন্য মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ফাউন্ডেশন নামে একটি দাতা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যেখান থেকে গরীব-দুঃখী সাধারণ মানুষের জন্য তিনি মানবিক সেবা প্রদান করেন। আসন্ন বায়রা নির্বাচন ২০২৬-২৮ এ তিনি সাবেক এমপি ও বায়রার সভাপতি এমএ সেলিম ও বায়রার সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন, বায়রা সম্মিলিত সমন্বয় ফ্রন্ট হতে যুগ্ম মহাসচিব পদে নির্বাচন করছেন। দেশের জনশক্তি রপ্তানীর বাজারের বর্তমান অবস্থা ও বায়রা ভ’মিকা কি হওয়া উচিত, সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে তিনি আমার বার্তাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন।
আমার বার্তা : আপনি আসন্ন বায়রা নির্বাচনে যুগ্ম মহাসচিব পদে প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচন করার মূল কারণ কী?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: আমি দীর্ঘদিন ধরে বায়রার সদস্য হিসেবে কাজ করছি। বায়রার ওয়েলফেয়ার সেক্রেটারি, কালচারাল সেক্রেটারি, পাবলিক রিলেশন সেক্রেটারি এবং জয়েন্ট সেক্রেটারি এই দায়িত্বগুলো পালন করে সদস্যদের কল্যাণে কাজ করেছি।
বর্তমানে বায়রাতে যে সিন্ডিকেট ও প্রতারণা চলছে, বিশেষ করে নতুন লাইসেন্সধারীদের ক্ষেত্রে, সেটার অবসান ঘটাতেই আমি আবার নির্বাচনে এসেছি। আমরা চাই সদস্যদের কল্যাণে বাস্তব কাজ করতে।
আমার বার্তা : আপনি যে প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন, সেই প্যানেলের নাম ও নেতৃত্ব সম্পর্কে জানতে চাই।
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: আমরা নির্বাচন করছি “বায়রা সম্মিলিত ফ্রন্ট” প্যানেল থেকে। এই প্যানেলের নেতৃত্বে আছেন সিলভার লাইনের সেলিম ভাই তিনি সাবেক এমপি, সাবেক দুইবারের সভাপতি এবং বায়রার একজন পরীক্ষিত নেতা। আমাদের লক্ষ্য ঐক্যবদ্ধভাবে বায়রাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা।
আমার বার্তা : আপনি আগে বায়রার জন্য কী কী কাজ করেছেন, একটু বলবেন?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, বায়রার সদস্যরা অসুস্থ হলে বা তাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
কাকরাইলের বায়রার জমি নিয়ে দীর্ঘদিন মামলা ছিল, আমি নিজে বাদী হয়ে প্রায় তিন-চার বছর লড়াই করে জমিটা নিষ্কণ্টক করেছি।
বাড্ডার পাঁচতলা ট্রেনিং সেন্টারের প্ল্যান অনুমোদন থেকে শুরু করে কমপ্লিট করেছি এবং ভাঙার ষড়যন্ত্র থেকেও রক্ষা করেছি।
আমার বার্তা : বর্তমানে বায়রার সবচেয়ে বড় সমস্যা কী?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সিন্ডিকেট ও বৈষম্য। নতুন লাইসেন্সধারী অনেক সদস্য আজও সৌদি অ্যাম্বাসিতে এনলিস্ট হতে পারছেন না। আমাদের প্রতিশ্রুতি, বিনা খরচে এনলিস্টমেন্ট সব দেশে সমানভাবে ব্যবসার সুযোগ বায়রা সদস্যদের মান-সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনা।
আমার বার্তা : জনশক্তি রপ্তানি খাতে বর্তমানে কী ধরনের সংকট দেখছেন?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: বর্তমানে নির্বাচিত সরকার না থাকায় বিএমইটি ও ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্সে জটিলতা বেড়েছে। আগে যেখানে ২৪ ধাপে ক্লিয়ারেন্স হতো, এখন অপ্রয়োজনীয় জটিলতার কারণে ভিসা বাতিল হচ্ছে। এই প্রতারণা ও জটিলতা দূর করাই আমাদের লক্ষ্য।
আমার বার্তা : মিডেল ইস্টের পাশাপাশি ইউরোপের বাজার নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: ইউরোপ থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো রেমিট্যান্স আসে, কিন্তু আমরা সেই বাজারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেইনি। অনেক ইউরোপীয় দেশে আমাদের দূতাবাস নেই, অ্যাটেস্টেশন জটিল প্রক্রিয়া। যদি সরকার ও দূতাবাসগুলো সহযোগিতা করে, তাহলে ইউরোপে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে একজন কর্মী পাঠাতে ৬০ দিন লাগে, অথচ অন্য দেশগুলো ৭ দিনের মধ্যে পাঠাচ্ছে, এখানেই আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
আমার বার্তা : দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ও বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে আপনার পরামর্শ কি?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: আমাদের পরামর্শ হলো, সব রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য উন্নতমানের ট্রেনিং সেন্টার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। প্রতিটি এজেন্সিকে আলাদা ট্রেনিং সেন্টার খুলতে হবে না। কেন্দ্রীয়ভাবে দক্ষতা উন্নয়ন করে কর্মী পাঠানো হবে।
আমার বার্তা : প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের তিন লাখ টাকার ঋণ নিয়ে আপনার মতামত কী?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: টাকার অঙ্ক বাড়ানোর চেয়ে সঠিকভাবে বিতরণ করাই বেশি জরুরি। সব কাগজপত্র থাকার পরও অনেক প্রবাসে গমণে ইচ্ছুক এই ঋণ পাচ্ছেন না। যাত্রীদের কাছ থেকে কল্যাণ ফান্ডের নামে টাকা নেওয়া হলেও প্রকৃত প্রবাসীদের কল্যাণে তা যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে না—এটা পরিবর্তন করতে হবে।
আমার বার্তা : আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বায়রা সদস্যদের জন্য আপনার বার্তা কী?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। এখন সময় এসেছে সদস্যদের জন্য কিছু দিয়ে যাওয়ার। আপনারা যদি বায়রা সম্মিলিত ফ্রন্ট ও সিলভার লাইনের সেলিম ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের প্যানেলকে ভোট দেন, তাহলে আমরা সিন্ডিকেটমুক্ত বায়রা সদস্য ও প্রবাসীদের প্রকৃত কল্যাণ দ্রুত ও স্বচ্ছ জনশক্তি রপ্তানি নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
আমার বার্তা : এবারের অভিবাসী দিবস কিভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: এবারের ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবসকে আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সময়োপযোগী ও ইতিবাচক বার্তাবহ হিসেবে দেখছি। কারণ, এবার প্রথমবারের মতো দিবসটি শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না থেকে দক্ষ অভিবাসন, প্রবাসীদের মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি—এই তিনটি বিষয়ের ওপর স্পষ্টভাবে গুরুত্ব দিয়েছে সরকার।
আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটির প্রতিপাদ্য “আমার মহান গল্প: সংস্কৃতি এবং উন্নয়ন” এবং জাতীয়ভাবে “দক্ষতা নিয়ে যাব বিদেশ, রেমিট্যান্স দিয়ে গড়ব স্বদেশ” এই দুই প্রতিপাদ্য একসঙ্গে আমাদের প্রবাসীদের অবদান, আত্মত্যাগ ও উন্নয়নমূলক ভূমিকাকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। এতে বোঝা যায়, সরকার এখন প্রবাসীদের শুধু রেমিট্যান্স আনার মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।
সরকার দালাল ও প্রতারণামুক্ত অভিবাসন ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছে এবং বিমানবন্দরে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ লাউঞ্জসহ সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগ এবারের দিবসের একটি ঐতিহাসিক দিক, যা প্রবাসীদের নাগরিক মর্যাদা আরও সুদৃঢ় করবে।
রেমিট্যান্সের দিক থেকেও প্রবাসীদের অবদান অসামান্য। প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। অথচ এতদিন তাঁদের সেই অবদান রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এবছর সিআইপি সম্মাননা, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান ও ব্যাংকগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ সেই ঘাটতি পূরণের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
সব মিলিয়ে, এবারের অভিবাসী দিবসকে আমি দেখছি প্রবাসীবান্ধব রাষ্ট্রনীতি গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা হিসেবে। যদি ঘোষিত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন হবে আরও নিরাপদ, দক্ষ ও মর্যাদাপূর্ণ—যার সুফল পাবে প্রবাসী, তাঁদের পরিবার এবং রাষ্ট্র।
আমার বার্তা : শ্রমবাজার বলতে এখন শুধুই সৌদি আরব, এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম: শ্রমবাজার বলতে বর্তমানে শুধু সৌদি আরবকে বোঝায় না, তবে এটি এখনও বাংলাদেশের জন্য একক বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজার। বর্তমানে সৌদি আরব বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের জন্য প্রধান গন্তব্য। ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে বিদেশ যাওয়া মোট কর্মীর প্রায় ৭৩ শতাংশই সৌদি আরবে গেছেন। দেশটিতে বর্তমানে ৩০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কাজ করছেন।
মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং ওমানের মতো বড় বাজারগুলো বর্তমানে নানা কারণে (যেমন কোটা বা প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা) কর্মী নিয়োগে ধীরগতি বা বন্ধ রয়েছে। তবে কাতার, কুয়েত, সিঙ্গাপুর এবং বাহরাইন এখনও বাংলাদেশি কর্মীদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য।
সরকার শ্রমবাজার সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ইতালি, রোমানিয়া, গ্রিস এবং রাশিয়ার মতো নতুন বাজারগুলোতে কর্মী পাঠানোর চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ইতালির সাথে একটি সমঝোতা স্মারক (গড়ট) স্বাক্ষরিত হয়েছে। সৌদি আরব এখন আগের মতো ঢালাওভাবে অদক্ষ শ্রমিক নিচ্ছে না। ২০২৫ সাল থেকে তারা ‘তাকামুল’ (Takamul) নামক দক্ষতা যাচাই পরীক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে, যা অদক্ষ কর্মীদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বাড়লেও সৌদি আরব থেকে আগের তুলনায় রেমিট্যান্স আসার হার কিছুটা কমেছে, যা বাজার বহুমুখীকরণের প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। সৌদি আরব এখনও প্রধান বাজার হলেও, শুধু একটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতা দেশের অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সরকারকে বর্তমানে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে।
আমার বার্তা/এমই
