শ্রম রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশি তরুণদের যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ায় নিয়োগ

সিন্ডিকেটের ভয়াবহ প্রতারণা

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:৫৩ | অনলাইন সংস্করণ

  জাহাঙ্গীর খান:

বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরির স্বপ্ন দেখিয়ে রাশিয়ায় পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণদের। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তাদের গন্তব্য হয়ে উঠছে যুদ্ধক্ষেত্র। শ্রম রপ্তানির নামে সংগঠিত একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র রিক্রুটিং এজেন্সির সহযোগিতায় বাংলাদেশিদের ইউক্রেন যুদ্ধে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নিতে ঠেলে দিচ্ছে। দেশজুড়ে ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি তরুণদের টার্গেট করে এই সিন্ডিকেট প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর শ্রমিকদের চাকরির বদলে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা প্রশিক্ষণ শিবিরে। পরে সরাসরি পাঠানো হয় ইউক্রেন ফ্রন্টলাইনে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া এসব যুবকের বেশির ভাগই লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও চুয়াডাঙ্গার বাসিন্দা। অভিযোগ উঠেছে বন্যা বিজয় ওভারসিজ লিমিটেড (আরএল ১৩৩৪), এসপি গ্লোবাল রিসোর্স (আরএল ২২৫৩), ম্যানিজ পাওয়ার করপোরেশন (আরএল ৯৭৩) এবং ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন রিক্রুটমেন্ট লিমিটেড এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত।

স্থানীয় দালালরা প্রথমে ‘উচ্চ বেতন, নিরাপদ চাকরি’এই প্রলোভনে তরুণদের সংগ্রহ করে। পরে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো রাশিয়ার একটি চীনা প্রতিষ্ঠান ‘সিনোপেক ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ রাশিয়া এলএলসি’-তে কাজের অফার দেখিয়ে পাঠায় তাদের। বাস্তবে পৌঁছানোর পরই শুরু হয় আরেক দুঃস্বপ্ন বাধ্যতামূলক সেনা প্রশিক্ষণ।

চুয়াডাঙ্গার মনিরুল ইসলাম নিখোঁজ আছেন সাত মাস। তার স্ত্রী লিপি বেগম জানান, ১১ লাখ টাকা দিয়ে বন্যা বিজয়ের মাধ্যমে রাশিয়ায় পাঠানো হয় মনিরুলকে। সেখানে পৌঁছে জানানো হয়—চাকরির বদলে তাকে নিতে হবে সামরিক প্রশিক্ষণে। ১৬ এপ্রিল তার শেষ বার্তা ছিল, আমি খুব বিপদে আছি, হয়তো আর কথা হবে না। এরপর কোনো খোঁজ নেই।

গাজীপুরের অয়নও একই কৌশলে রাশিয়া যান। তার বাবা রতন মণ্ডল বলেন, ছয় লাখ টাকায় চাকরি হবে বলা হয়েছিল। পরে জানলাম, আমার ছেলে সেনা ক্যাম্পে। সর্বশেষ বার্তায় অয়ন শুধু লিখেছিলেন—“যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

চট্টগ্রামের অমিত বড়ুয়ার পরিবার আরও করুণ। একই ক্যাম্পে থাকা আরেক শ্রমিক ভয়েস মেসেজে জানায় ইউক্রেনে রকেট হামলায় অমিত নিহত হয়েছেন। তার সঙ্গে আহত সোহাগও পরে মারা যায় বলে জানানো হয় পরিবারকে।

লক্ষ্মীপুরের সাজ্জাদ হোসেন, ময়মনসিংহের মহসিনসহ অনেকে এখন নিখোঁজ। তাদের পরিবার বলছে, আমাদের ছেলেদের সেনাবাহিনীতে বিক্রি করে দিয়েছে দালালরা।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে এসপি গ্লোবাল রিসোর্সের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের নাম ব্যবহার করে কেউ প্রতারণা করলে তার দায় আমাদের নয়। বন্যা বিজয়ের ম্যানেজার আকিব ইসলাম বলেন, আমরা কাউকে সেনাবাহিনীতে পাঠাইনি। কেউ চাকরি ছেড়ে সেনাবাহিনীতে গেলে সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বলেন, এটি প্রতারণার নতুন ধরণ। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দুর্বল অবস্থার তরুণদের টার্গেট করা হচ্ছে। সরকারি নজরদারি ও আন্তর্জাতিক সমন্বয় ছাড়া এই সিন্ডিকেট থামানো যাবে না।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর দৈনিক আমার বার্তাকে বলেন, রাশিয়ায় শ্রমিক পাঠিয়ে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হয়েছে এমন অভিযোগ আমরা গভীর নজরে দেখছি।

পরিবারগুলোর আর্তি একটাই যাদের পাঠানো হয়েছে তাদের খোঁজ ফিরিয়ে আনা হোক। যুদ্ধের ময়দানে নয়, তারা তাদের প্রিয়জনকে ফিরে পেতে চান ঘরের দরজায়।


আমার বার্তা/এমই