‘ভুতুড়ে’ অডিটের ফাঁদে রেল
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ২২:১৩ | অনলাইন সংস্করণ
বিশেষ প্রতিবেদক:

‘ভুতুড়ে’ অডিটের কারবারে তোলপাড় চলছে বাংলাদেশ রেলওয়েতে। প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয়ের সঙ্গে কথিত অডিটের বাস্তবতার মিল নেই। প্রকল্পের বাজেটের চেয়ে চার গুণ দেখানো হয়েছে অডিট নিরীক্ষা প্রতিবেদন। যেমনটি ঘটেছে ফরেন এইডেড প্রজেক্ট অডিট ডিরেক্টরেট (ফাপাড)-বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে। অবাক করা বিষয় ৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে অডিট আপত্তিই এসেছে ১৫ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা! অবিশ্বাস্য নয় সত্য এটি। মূলত ভাড়াটে অডিট দলের অপেশাদার ও অনভিজ্ঞদের দিয়ে এমন অডিট করিয়ে এক মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করতে গিয়ে উল্টো তুমুল বিতর্ক তৈরি করেছে অডিট অধিদপ্তর।
তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই প্রক্রিয়ায় গাফিলতি, অপর্যাপ্ত নথিপত্র ও গবেষণার মানহীনতা চিহ্নিত হওয়ার পর অবশ্য ফাপাডের অডিট টিমের দলনেতা একেএম জুবায়ের দায় চাপিয়েছেন আরেকজনের ওপর। নিজেও স্বীকার করেছেন অডিট আপত্তি চূড়ান্তভাবে তিনি দাখিল করেননি। জুবায়ের এই বিষয়ে বলেন, ‘আমাদেরকে এই অডিট আপত্তি তৈরিতে আমাকে ধার করে নেওয়া হয়েছিল। আমরা একটি ড্রাফট করে অধিদপ্তরে জমা দেওয়ার পর বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট অধিদপ্তর সেক্টর-৫ এর উপপরিচালক শাহনেওয়াজ শাওন রিফাইন করে অডিট আপত্তি ফাইনালি সাবমিট করে থাকতে পারেন।’
সা¤প্রতিক সময়ে রেলের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসমূহে একই রকম ঘটনার অবতারণা হলেও ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার অডিট আপত্তির গল্প। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ও যমুনা রেলসেতু নির্মাণ প্রকল্পে অস্বাভাবিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্যে সম্পাদিত অডিট নিয়ে তীব্র হচ্ছে অসন্তোষ। সামনে এসেছে নিরীক্ষা দলের প্রধান ও সদস্যদের পেশাগত দক্ষতা এবং অনুসন্ধান পদ্ধতির ছলচাতুরী নিয়েও। রেলওয়ের বিরুদ্ধে এমন অপতৎপরতাকে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। বিশেষ করে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এমন একজন উপদেষ্টা রয়েছেন যিনি সচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া সময় পর্যন্ত ছিলেন সততার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। ‘বিশ্বস্ত সারথী’ হিসেবেই রেলসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের ভার উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাঁধে তুলে দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল লরিয়েট ড.মুহাম্মদ ইউনূস। রেল, সড়ক ও বিদ্যুৎ জ্বালানী তিন মন্ত্রণালয় সমানতালে নেতৃত্ব দিয়ে গত এক বছরে সরকারে প্রায় রেকর্ড ৪৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের সাফল্যও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পসমূহে এমন ভেজাল ও নামকাওয়াস্তে মানহীন গবেষণা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করারও অপকৌশল হিসেবেই দেখছেন অনেকেই। বর্তমান সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ের দিক থেকেও উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের এই মন্ত্রণালয়টি রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। রেল মন্ত্রণালয়ের ৫টি প্রকল্প থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমিয়েছে সরকার। আর এতেই একটি বিশেষ মহলের গাত্রদাহ তৈরি হয়েছে। প্রশংসার বদলে উল্টো মিথ্যাচার হজম করতে হচ্ছে উপদেষ্টা থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম ও রেলওয়ের ডিজি আফজাল হোসেনকে। উপদেষ্টার নির্দেশে অপচয় কমিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে রীতিমতো চমক দেখিয়েছেন সচিব ও ডিজি। কিন্তু তাদেরকে নিয়ে নোংরামির নিত্য নতুন ডানা মেলতে শুরু হয়েছে।
জানা যায়, কম কথার প্রথাবিরোধী মানুষ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ‘রেলের কালো বিড়াল’ অনুসন্ধানের তথাকথিত ধাপ্পাবাজির পথে না হেঁটে শুরুতেই ঘোষণা দেন ব্যয় সাশ্রয়ে অগ্রাধিকারের কথা। একটি কার্যকর ‘টিম’ গড়তে সচিব হিসেবে বেছে নেন জনপ্রশাসনে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হিসেবে পরিচিত সেতু বিভাগের বিদায়ী সচিব ফাহিমুল ইসলামকে। ডিজি হিসেবে বাছাই করেন রেলের বিভিন্ন পদে সফল ও সন্তোষজনকভাবে কাজ করা আফজাল হোসেনকে। দু'জনই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন।
উপদেষ্টার নির্দেশে তাঁরা অভূতপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে রেলের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি প্রকল্প থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমিয়ে ড.ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দৃষ্টান্ত তৈরি করেন। রেলের ভাগ্যাকাশে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ সরিয়ে উজ্জ্বল সোনালী রোদ্দুরে নতুন দিগন্ত রেখা উন্মোচনের প্রান্তসীমায় নানা বদনাম ও অপবাদ দিয়ে অপতথ্যকেই তাদের বিরুদ্ধে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় মন্ত্রণালয়ের ভেতরে-বাইরে ক্ষোভ-অসন্তোষ দানা বাঁধছে।
জানা যায়, রেলের ৫টি প্রকল্প প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, পূর্ত প্যাকেজ, পুনর্ভরণযোগ্য সিডি-ভ্যাট, পরামর্শক নিয়োগ ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনাসহ আনুষঙ্গিক খাত থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি ব্যয় কমিয়ে উপদেষ্টার অ্যাসাইনমেন্টে সফল হয়েছেন। ধরে রেখেছেন আস্থা-বিশ্বাস। এতে করে উপদেষ্টার এই সক্রিয় টিমকে ঘিরে বিপুল জনপ্রত্যাশাও তুঙ্গে উঠেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ছয় হাজার ৬৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় কমানো হয়েছে। মূল প্রকল্প থেকে ব্যয় কমেছে ৩৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ব্যয় কমানো হয়েছে ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। ঢাকা-যশোর রেলপথে নির্মাণাধীন এক স্টেশনেই ব্যয় কমছে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। স¤প্রতি পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হবে ২০২৬ সালের জুনে। প্রকল্পে মোট ব্যয় সাশ্রয় হবে ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা।
এছাড়া আখাউড়া-লাকসাম রেল প্রকল্পে এক হাজার ৫০ কোটি টাকা, খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ১০০ কোটি ও যমুনা রেলওয়ে সেতু প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকা ব্যয় কমছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চলতি বছরের মার্চে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত রেলসেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। রেলপথ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সব প্রকল্পের ডিপিপি পুনরায় বিশ্লেষণ করেই ব্যয় কমানো হয়েছে। মোট পাঁচটি প্রকল্পের সাশ্রয় হওয়া প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে।
এদিকে, জনগুরুত্বপূর্ণ এসব প্রকল্পে বিশেষ করে পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প, যমুনা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প ও খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে অডিটকে নিয়ে চলছে তুঘলকি কারবার। ফিল্মি কায়দায় বৃহৎ এসব প্রকল্পে ‘দুর্নীতি’ ট্যাগ দেওয়ার অপকৌশল প্রকাশ্যে এসেছে। একের পর এক গুজব ও কুৎসা রটানো হচ্ছে। বিশেষত রেলের ডিজি আফজাল হোসেনকে জড়িয়ে কোন প্রমাণ ছাড়াই বিভিন্ন মাধ্যমে দুর্নীতির কল্পকাহিনী ফাঁদা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের কোন নিরীক্ষা প্রতিবেদন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনো অনুসন্ধান রিপোর্ট, আদালতের কোনো মামলা বা রায় না থাকা, সরকারি কোনো নথি না থাকলেও অনুমান নির্ভর বয়ানের মাধ্যমে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপতৎপরতা চলছে একদিন-প্রতিদিন।
তবে অভিজ্ঞরা বলছেন, নিরীক্ষা বা অডিট সরকারের একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া, যাতে সরকারের ব্যয় সংশ্লিষ্ট আর্থিক নিয়মাবলি অনুসারে সম্পাদন হয়েছে কিনা তা যাচাই করা হয়। সরকারের প্রতিটি দপ্তরই অডিটের আওতাধীন। একটি অডিট নিরীক্ষা অন্তে নিরীক্ষকরা তাদের মন্তব্য পেশ করেন যার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কার্যালয় তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন এবং উভয়ের সমন্বয়ে দায় নির্ধারণ হয়।
সরকারি নথিপত্রে ‘অডিট আপত্তি’ শব্দটি ‘দুর্নীতি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িতই নয়। দুদক বা পুলিশের মাধ্যমে তদন্ত ছাড়া কিংবা আদালতের রায় ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ তোলা শুধুই ‘মতামত’ বা ‘রাজনৈতিক ব্যাখ্যা’- যা কোনোভাবে আইনসিদ্ধ নয়। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-তে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে- বিধি ৩(ক): কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হলে লিখিত অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। বিধি ৫ অনুযায়ী, যথাযথ তদন্ত ব্যতীত শাস্তি দেওয়ার বিধান নেই এবং প্রতিটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ‘শোকজ’ বা কারণ দর্শানোর নোটিশ আবশ্যক।
কিন্তু এর আগেই কোন কোন মাধ্যমে অবান্তর ও অবাস্তব আষাঢ়ে গল্পে প্রতিহিংসার বয়ানের সিনেমাটিক কল্পকাহিনীর মাধ্যমে রেলের কর্মতৎপর ও নিষ্ঠাবান ডিজিকে ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে প্রমাণের অপচেষ্টা চালাচ্ছে একটি চক্র। অথচ রেলের একটি প্রকল্পের ফাপাডের অডিট টিমের দলনেতা একেএম জুবায়ের নিজেও স্বীকার করে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ‘অডিট আপত্তিকে সরাসরি দুর্নীতি বলা যাবে না। অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি যোগ্য।’ রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, এ ধরনের অপপ্রচার আসলে জাতীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করবে।
আমার বার্তা/এমই