বগুড়ার গাবতলীর সেই ইউএনও ওয়ারেছ আনসারীর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ

প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:২৩ | অনলাইন সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক:

সাবেক ইউএনও আবদুল ওয়ারেছ আনসারী
  • ফ্যাসিস্ট আওয়ামী পরিবারের সদস্য এবং বিশাল দুর্নীতি করেও বহাল তবিয়তে 

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী পরিবারের সদস্য ঢাকা জেলার তেজগাঁও উন্নয়নের সার্কেল অফিসার মো. আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী বিরুদ্ধে অসদাচরণ, অর্থ আত্মসাৎ, ইজারা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। তিনি যেখানেই চাকুরি করেছেন সেখানেই ঘুষ দুর্নীতির রাম রাজস্ব কায়েম করেছেন।

নারায়ণগঞ্জে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (মানবসম্পদ) পদে থাকাকালে নিয়োগ, বদলি ও পদায়ন বানিজ্য এবং বিভিন্ন প্রার্থী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।

বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) উপপরিচালক (সিনিয়র সহকারী সচিব) হিসেবে কর্মরত থাকাকালিন তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) থাকাকালিন আব্দুল ওয়ারেছ আনসারীর বিরুদ্ধে অসদাচরণ, অর্থ আত্মসাৎ, ইজারা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ডাকুমারা হাটের ইজারায় অনিয়মের ঘটনায় আব্দুল ওয়ারেছ আনসারীর দুই বছর বেতন না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দীন চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এই লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গাবতলী উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন হাট-বাজারের বাংলা ১৪২৬ সনের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ডাকুমারা হাটের ইজারা দিতে ৪টি (চার) দরপত্র দাখিল করা, সর্বোচ্চ ডাককারী মো. আহসান হাবিব সেলিমের দর ১ কোটি ৮৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা সর্বোচ্চ হওয়ায় তাকে অবশিষ্ট টাকা জমা প্রদানের জন্য পত্র দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ইজারামূল্য পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করায় তার ইজারা বাতিলপূর্বক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা মো. আব্দুল মতিন সরকারের দাখিলকৃত ১ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার ১০০ টাকার দর গ্রহণ না করে চতুর্থ পর্যায়ে দরপত্র আহ্বান করে ফের একই ব্যক্তি মো. আহসান হাবিব সেলিমের অনুকূলে ১ কোটি ৮৪ লাখ ৯০ হাজার টাকার স্থলে ৯১ লাখ ১১ হাজার ১১১ টাকায় ইজারা প্রদান করা এবং ডাকুমারা হাটের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতা মো. আহসান হাবিব সেলিম তার দাখিলকৃত উদ্ধৃত দরের টাকা যথাসময়ে জমা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারি হাট-বাজার ইজারা নীতিমালা, ২০১১ অনুযায়ী উদ্ধৃত দরের ৩০ শতাংশ জামানত ৫০ লাখ ৪৭ হাজার টাকার পরিবর্তে ৫ শতাংশ জামানত ৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করে সরকারের ৪৬ লাখ ১ হাজার ৫শ টাকার রাজস্ব ক্ষতিসাধন করা হয়। এ অভিযোগে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর ৩(খ) ও ৩(ঘ) বিধি অনুযায়ী যথাক্রমে ‘অসদাচরণ’ ও ‘দুর্নীতিপরায়ণ’-এর অভিযোগ এনে একই বিধিমালার বিধি ৪(৩)(ঘ) অনুযায়ী কেন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না বা অন্য কোনো উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করা হবে না এ মর্মে উক্ত বিধিমালার বিধি ৭(১)(খ) মোতাবেক প্রাপ্তির ১০ (দশ) কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য বলা হয় এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি ব্যক্তিগত শুনানি চান কি না, তাও তার লিখিত জবাবে উল্লেখ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। বিভাগীয় মামলার অভিযোগ ও সার্বিক বিষয় পর্যালোচনাপূর্বক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৭ (২) (ঘ) বিধি অনুযায়ী মামলাটি তদন্ত করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হলে তদন্ত কর্মকর্তা গত বছরের ২ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনাপূর্বক পুনঃতদন্ত প্রয়োজন মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় গত বছরের ২৬ অক্টোবর মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য তদন্ত কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করা হলে তদন্ত কর্মকর্তা মামলাটি পুনঃতদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে, উল্লিখিত ৯৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮৯ টাকা রাজস্ব ক্ষতিসাধনের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি, তবে ডাকুমারা হাটের প্রথম পর্যায়ে ইজারা ডাকে সর্বোচ্চ দরদাতা মো. আহসান হাবীব সেলিমের দরপত্র বাতিল করে জামানত হিসেবে জমাকৃত ৩০ শতাংশ অর্থের মধ্যে ৫ শতাংশ অর্থ বাজেয়াপ্ত করে ২৫ শতাংশ অর্থ ইজারা ডাককারীকে ফেরত দিয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তা কর্তব্য কাজে অবহেলা ও সরকারের ৪৬ লাখ ১ হাজার ৫০০ টাকা রাজস্ব ক্ষতি করেছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়।

সেহেতু সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩(খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে অসদাচরণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে একই বিধিমালার ৪(২)(খ) বিধি অনুযায়ী তার ‘বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড প্রদান করা হলো এবং তিনি ২ বছরের বর্ধিত বেতন কখনো প্রাপ্য হবেন না, ২ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তৃতীয় বছর থেকে তিনি বর্ধিত বেতন প্রাপ্য হবেন মর্মে নির্দেশ প্রদান করা হলো। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।

এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকে ২০১৩ সালের ২২ জুলাই ‘মো. আবদুল ওয়ারেশ আনসারী’ নামে একজন ব্যক্তি সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করে পরবর্তী প্রায় ১২ বছর কর্মরত ছিলেন। অথচ তিনি নন ‘আসল’ ওয়ারেছ আনসারী আসল ব্যক্তি তখন ৩১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন এবং বর্তমান সময়ে ঢাকা জেলার তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেলের দায়িত্বে রয়েছেন। ঘটনাটি যদি সামগ্রিকভাবে সত্য হয়, তাহলে প্রশ্ন দেখা দেয় কীভাবে একই নাম, পিতা-মাতা, স্থায়ী ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত কাগজপত্র সবকিছু ‘দুর্ভেদ্য’ভাবে মিলিয়ে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে সফলভাবে চাকরি করতে পারেন। সেখানে তো নিয়োগ ও ভেরিফিকেশনের একাধিক স্তর থাকে: লিখিত-মৌখিক পরীক্ষা, ভেরিফিকেশন, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, আবেদনপত্রে দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও শিক্ষাগত সনদের সত্যতা যাচাই, মেডিকেল; এসব স্তর পেরোনো কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কঠিন। কারণ, কারও পুরো নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, জন্মতারিখ, ঠিকানা, এমনকি শিক্ষাজীবনের পর্যায়ক্রমিক সনদ এ রকম সূক্ষ্ম তথ্যের ‘হুবহু’ মিল তৈরি করতে হলে হয় বিশেষ দক্ষ চক্রের সহায়তা লাগে, না হয় তথ্য-অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার পাওয়া কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ছায়া থাকে; উভয় অবস্থাতেই অপরাধ দুর্বল নয়, বরং সংগঠিত ও উচ্চঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে ‘ভুয়া’ পরিচয়ে নিয়োগ ও দীর্ঘস্থায়ী চাকরির ঘটনাকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই; এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হলে দণ্ডবিধি, দুর্নীতি দমন আইন, জালিয়াতি ও প্রতারণার ধারাসহ সরকারি চাকরিজীবী আচরণবিধির একাধিক বিধান লঙ্ঘনের বিষয় দাঁড়ায়।

বর্তমান ঢাকা জেলার তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্ব এই দুই জায়গায়ও সেবা প্রত্যাশীদের সঙ্গে অসাদাচরণ, ফাইল-প্রসেসিং টাইমলাইন, ই-নথিতে অস্বাভাবিক বিলম্ব এসব ডেটা-ড্রিভেন মেট্রিক্স দিয়ে রিভিউ করলে প্রশাসনিক মানচিত্র আরও পরিষ্কার হবে। ‘রেড ফ্ল্যাগ’ যেমন হঠাৎ করে কোনো নির্দিষ্ট কন্ট্রাক্টরের ধারাবাহিক জয়, নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের আবেদন বারবার ‘কারেকশন’-এ আটকে থাকা, রাতারাতি ফাইল অগ্রগতি, অথবা ‘ক্লোজড মিটিং’-এর পর সিদ্ধান্ত বদল এসবই অনিয়ম।

অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা জেলার তেজগাঁও উন্নয়নের সার্কেল অফিসার মো: আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী জানান তার বিরুদ্ধে আনীত সমস্ত অভিযোগ নিস্পত্তি হয়েছে। প্রতিপক্ষের লোকজন ঈর্ষান্নিত তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।


আমার বার্তা/এমই