পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে সরকার অর্থ ছাড় বন্ধ রাখায় বড় বিপর্যয়ে সিআরইসি

দু'দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েনের শঙ্কা

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ১৮:০২ | অনলাইন সংস্করণ

  বিশেষ সংবাদদাতা :

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৩ হাজার কোটি টাকার অডিট আপত্তিকে ঘিরে বন্ধুপ্রতীম বড় উন্নয়ন সহযোগী চীনকে ঘিরে দেদারসে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও বিল পাচ্ছে না চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি)। সরকার অর্থ ছাড় বন্ধ রাখায় বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন তারা। প্রকল্পের গতি সচল রাখার জন্য সিআরইসি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বৃহৎ অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে। কোভিড-১৯ মহামারির কঠিন সময়েও রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ যথাসম্ভব নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সাম্প্রতিক তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভবিষ্যতে জনস্বার্থে এমন প্রকল্প থেকে চীন মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। একই সঙ্গে দুটি দেশের সম্পর্কেও টানাপোড়ন তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 

জানা যায়, সম্প্রতি পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে চীন বাংলাদেশের পতিত সরকারের এই প্রকল্প থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মওকা পেয়েছে, এই প্রকল্পটির ঠিকাদার নিয়োগে দর যাচাই হয়নি,  সরাসরি চীনারা কাজ পেয়েছে ইত্যাকার অভিযোগ এনে বর্তমান সরকারকে বিব্রত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে শীর্ষ ঋণদাতা এই দেশটিকে নিয়ে অপপ্রচার ছড়িয়ে প্রতিবেশী একটি দেশকে বাড়তি সুবিধা দেওয়াই এসব অপপ্রচারের প্রধান উদ্দেশ্যে কীনা এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখার দাবি ওঠেছে। কারণ, ভূ-রাজনৈতিক কৌশল, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কারণেও বাংলাদেশ ও চীনের একে অপরের কাছে আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও গভীর করতে আগ্রহী দু'দেশই। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগে আগ্রহী। 

প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রকৌশল পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গুরুত্ব 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাম্প্রতিকভাবে যে অডিট আপত্তির কথা কোন কোন মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে সেটি মূলত ৪২টি খাত ও ৭টি অতিরিক্ত ব্যয়ের পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করেই। সংশ্লিষ্ট বিভাগের স্বীকৃত ও অনুমোদিত খাতেই প্রকল্পের প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণে অনুমোদনের তুলনায় ব্যয় বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ মাটি ও নদীপ্রবাহ বিশ্লেষণে ব্যয়, অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ (এজিএল), কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে খরচ, সফটওয়্যার ও রিপোর্টিং খাতে অর্থ বরাদ্দ, প্রোভিশনিং বা ‘প্রোভিশনাল সাম’ খাতে অর্থ সংরক্ষণের বিষয়ে আপত্তির কথা বলা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের বাস্তব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্যই প্রকৌশল পরিকল্পনা মোতাবেক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেই এসব গ্রহণ করা হয়েছিল। 

একই সূত্র বলছে, প্রকৌশল বাস্তবতায় অডিট আপত্তির বিষয়টি ধোপে টিকবে না। কারণ, আন্তর্জাতিকমানের প্রকল্প বাস্তবায়নে এই ব্যয় অস্বাভাবিক নয় মোটেও। অতিরিক্ত জমি (এজিএল) প্রকল্প রক্ষায় অপরিহার্য। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ব্যয়—ব্যর্থতা নয় গুরুত্বপূর্ণ, তথ্য ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় আধুনিক প্রকল্প ব্যবস্থাপনার অংশ এবং প্রোভিশনিং ব্যয় আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ ও নীতিনির্ধারিত। 

যুক্তি হিসেবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রকল্পে ভূমিকম্প সহনশীল রেললাইন, হাইড্রোলজিক্যাল ও টেকনিক্যাল পরীক্ষাসমূহ, নদীশাসন, টানেলিং, একাধিক স্টেশন নির্মাণ, লজিস্টিক সাপোর্ট এবং জটিল কারিগরি সংযোজন রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতেও এমন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় খুব স্বাভাবিক। বিশেষত যেখানে প্রকল্পটি নদী ও সমতলভূমির মাঝামাঝি ভূপ্রকৃতিতে অবস্থিত। এছাড়া অতিরিক্ত গ্র্যান্ড অফ ল্যান্ড (এজিএল) প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনার অংশ। ভবিষ্যতে রেললাইন সম্প্রসারণ, নিরাপত্তা বাফার, সাইডিং রেল, সিগনালিং ব্যবস্থা, সাবস্টেশন ইত্যাদির জন্য ভূমি প্রয়োজন হয়। এই জমি অধিগ্রহণকে 'অতিরিক্ত ব্যয়' হিসেবে দেখানো প্রকৌশল অজ্ঞতার পরিচায়ক, যেটি অর্বাচীনের প্রলাপের মতোন। 

করোনার দহন যন্ত্রণার সময় সেই সময়কার সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই প্রকল্প চালু রেখেছিল। এতে ব্যয় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও, কাজ বন্ধ না হওয়ার ফলে ভবিষ্যতের বড় ক্ষতি থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে। শ্রমিকের সুরক্ষা সামগ্রী, আবাসন, চিকিৎসা সহায়তা ও পরিবহন ইত্যাদি খাতে ব্যয় হয়েছে নিয়ম মেনেই। পাশাপাশি ডকুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ডিএমএস), রিপোর্টিং সফটওয়্যার, ক্লাউড সার্ভার, প্রকল্প পর্যবেক্ষণ সফটওয়্যার—সবকিছু একটি আন্তর্জাতিকমানের প্রকল্পে অপরিহার্য। এসব ব্যয়কে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা প্রশ্নবোধক। বিশ্বব্যাপী বড় প্রকল্পে অনিশ্চিত খরচ মোকাবিলায় ‘প্রোভিশনিং’ খাতে একটি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। এটি দুর্নীতি নয়, বরং সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। 

প্রকল্পে মোট ব্যয় সাশ্রয় ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা 

'পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের’ পুরো ১৭২ কিলোমিটার রেলপথেই হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছুটছে। ফলে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু এবং গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী হয়ে যশোর-খুলনা রেলপথে যাতায়াতের দূরত্বের সময় কমবে প্রায় সাড়ে ৩ ঘন্টার মতো এবং যশোর-বেনাপোল রেলপথে ৪ ঘন্টার মতো। প্রতিটি সেকশনে পথ কমবে প্রায় অর্ধেকের বেশি।

প্রকল্পের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা, রাজাবাড়ী, চুয়াডাঙ্গা ও যশোর হয়ে খুলনার দূরত্ব ৪১২ কিলোমিটার। কিন্তু নড়াইল হয়ে যশোরের পদ্মবিলা জংশন রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রকল্পের রেলপথটি ১৭২ কিলোমিটার। ফলে এই পথে খুলনা যেতে দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে ১৯২ কিলোমিটার। যা সময়ের হিসেবে সাড়ে ৫ ঘন্টা কম লাগছে। বর্তমান পথে ঢাকা থেকে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ৪১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৭ ঘন্টা ৩৫ মিনিট। প্রকল্পের রেলপথ দিয়ে ট্রেনটি ৪ ঘন্টার মধ্যে খুলনা পৌঁছাতে পারছে। 

গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত পুরো পথই অবশেষে চালু হয়। ওইদিন প্রথমবারের মতো পদ্মা সেতু রেলপথ দিয়ে খুলনা ও বেনাপোল থেকে ঢাকা রুটে ট্রেন চললো। প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু হওয়ায় এই দুই রুটে যাত্রার সময় ও দূরত্ব দুটিই কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সেদিন এই ট্রেন যাত্রার উদ্বোধন ঘোষণা করেন রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন উপস্থিত ছিলেন। ফাওজুল কবির খান বলেন, আজ (মঙ্গলবার) আমাদের জন্য একটা আনন্দের দিন। আজ (মঙ্গলবার) খুলনা থেকে ঢাকায় ট্রেন চালু হচ্ছে পদ্মা রেল সংযোগ দিয়ে। পৌনে ৪ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবে ঢাকায়। তিনি বলেন, রেলের আয় দিয়ে ব্যয় নির্বাহ করতে হবে। সব খাতেই ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এটা কতো দেয়া যায়? আমাদের ব্যয়সাশ্রয়ী হতে হবে। আমাদের ব্যয় আশপাশের দেশ থেকে অনেক বেশি। সবাইকে অনুরোধ জানাবো, কীভাবে খরচ কমানো যায় তা করতে। এটা হলে সেবা দিতে সক্ষম হবো।' 

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা দায়িত্ব নিয়ে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে ব্যয় কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ঢাকা-যশোর রেলপথে নির্মাণাধীন এক স্টেশনেই ব্যয় কমছে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হবে ২০২৬ সালের জুনে। প্রকল্পে মোট ব্যয় সাশ্রয় হবে ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত প্রকল্পে সরকারি অংশে ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে ৫৪১ কোটি ৩১ লাখ টাকা এবং প্রকল্প ঋণ অংশে ব্যয় কমেছে ১ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। সবকিছু চূড়ান্ত হলে সামনে আরও ব্যয় সাশ্রয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।

 

আমার বার্তা/এমই