আনসার-ভিডিপির নিরব বিপ্লব

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূলে বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে আনসার বাহিনী: মহাপরিচালক

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:০২ | অনলাইন সংস্করণ

  রতন বালো

আনসার কথাটির অর্থ হচ্ছে সাহায্যকারী। নিয়মিত বাহিনীর সহায়ক হিসেবেই এই বাহিনীর অভ্যূদয় ঘটে। প্রথম থেকেই জনসাধারণের কল্যাণে ও গণমানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আনসার ভিডিপি তাদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে। সময়ের পরীক্ষায় তা বেশ ভালোভাবেই পরিচিতি পায়। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাদের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। একসময় গ্রামীণ আইনশৃঙ্খলা বির্নিমাণে  আনসার বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় ভিডিপি (গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী)। পরবর্তীতে এই দুই বাহিনীর একত্রীকরণে এর নাম হয় আনসার- ভিডিপি। 

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এই বাহিনী পঞ্চাশ বছর পার করেছে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বর্তমানে এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬১ লাখ। যার  সদস্যরা জনসম্পৃক্ত ও জনসুশৃঙ্খল বাহিনী হিসাবে সাধারণে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এ সেক্টরের ৪২টি ব্যাটালিয়নের ১৭ হাজার সদস্য পার্বত্যাঞ্চল, জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশ সচিবালয়, রাষ্ট্রীয় তোষাখানা, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিমান ও স্থলবন্দরে  নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে মোবাইল কোর্ট ডিউটিতে সহযোগিতা করে আসছে। এছাড়াও তারা ধর্মীয় জঙ্গীবাদ দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। জঙ্গীবাদ মোকাবিলা, একই সঙ্গে তা প্রতিরোধে এই বাহিনীর ভূমিকায় গর্বিত দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। 
 
এই বাহিনীর ৫৪ হাজারের অধিক আনসার সদস্য ৫ হাজারের অধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, পোশাক-শিল্প কারখানা, পাঁচতারকা হোটেল, মোটেল, শপিংমল, মাতার বাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, ইপিজেড, রেলস্টেশন এবং রাজপথে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিজেদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৬৪টি জেলা কার্যালয়ে ৫০ জন সদস্য ৫০ মিনিটের জাতীয় পতাকা র‌্যালি ৯টি বিভাগীয় কার্যালয়ে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম্রকাননে বাহিনীর নিজস্ব অর্কেস্ট্রা দল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছে। এবারও আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ৪৩তম জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে এই বাহিনী। এ উপলক্ষ্যে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচী।  

এছাড়া এ বাহিনীর তালিকাভুক্ত অস্বচ্ছল ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে ‘বীরনিবাস’ নির্মাণ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। এছাড়াও বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার ও আলোকচিত্র ধারণ করে আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হয়েছে। গত বছর সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের লক্ষ্যে সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। যেখানে অংশ নিয়ে গত ২২ সালে আনসার ও ভিডিপি সদস্যগণ বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সারাদেশে ৩ হাজার ৩১৪টি প্রাকৃতিক বজ্রনিরোধক তাল গাছ রোপণ করেছে। পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেডিকেল ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা যা এই বাহিনীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা জনহিতকর কর্মকাণ্ড। এসবই জানা গেছে এই বাহিনীর জণসংযোগ সূত্রে ।

আজ বুধবার আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর হেড অফিসে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক (এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি ও পিএইচডি) এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ শান্তির দেশ, আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলেই দেশের উন্নয়ন হয়। আর দেশের উন্নয়ন মানেই প্রতিটি পরিবারেরই উন্নয়ন। প্রতিটি পরিবার স্বচ্ছলভাবে চলাচল করুক। সুন্দরভাবে বাঁচুক সেটাই আমরা চাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর রয়েছে সক্রিয় অংশগ্রহণ।

গতকাল বুধবার বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর হেড অফিস কার্যালয়ে মহাপরিচারক মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হকের সাক্ষাৎ নিচ্ছেন দৈনিক আমার বার্তার বিশেষ প্রতিনিধি

 

তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে দায়িত্ব। বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে নিরাপত্তায় আমাদের আনসার ভিডিপি যথেষ্ট অবদান রাখছে।  বিশেষ করে আমাদের বিমানবন্দর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এই বাহিনী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরনে সর্বোচ্চ সেবার স্বাক্ষর রাখছে। এমনকি  কূটনৈতিক পাড়া, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা-বিশেষ করে ব্যক্তি বা বিভিন্ন বেসরকারি শিল্প কারখানা, প্রতিটি জায়গায় আনসার বাহিনীর অবদান অনিস্বীকার্য। মহামারি করোনা মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা দেশীয় ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে। 

এছাড়াও জনসাধারণের জান-মালের নিশ্চয়তায় এই বাহিনী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালন করেছে। বিশেষ করে বিএনপি জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস, যখন তারা বাস-গাড়ি-রিকশা-ভ্যান, এমনকি রেলগাড়ি এবং রেললাইনে অগ্নি সন্ত্রাস চালিয়েছে, পেট্রোল বোমা মেরে মানুষের জীবন বিপন্ন করার মরণ খেলায় মেতেছিল, তখন এই বাহিনী দেশপ্রেমকে পুঁজি  করে সেই সন্ত্রাসের মোকাবিলা করেছে।  সেই সময় সরকার এই বাহিনীর উপর  আস্থা রাখে। মানুষের নিরাপত্তা, সেইসঙ্গে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্ত রেল লাইনের নিরাপত্তার ভার তুলে দেয়। যে দায়িত্ব আনসার ভিডিপি যথাযথভাবে পালন করে জনগণের ভালোবাসা অর্জন করেছে। সন্ত্রাস প্রতিরোধে নেমে এই বাহিনীর অনেককে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে তারপরেও তারা দায়িত্বকে অবহেলা করেনি। এমনকি জীবন দিয়েও তারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিয়েছে। সেই সব বীরদের আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি বলে জানালেন বাহিনীটির মহাপরিচালক আমিনুল হক। 

আমিনুল হক বলেন, আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নে আমাদের আনসার-ভিডিপির যে অবদান রয়েছে, সেটা সব সময় সরকার ও জনগণ স্বীকার করে। ১৯৯৬ সালে  আওয়ামী লীগ যখন জনগণের ভোটে প্রথম সরকার গঠনে সমর্থ হয়, তখন এ বাহিনীর অনেক সমস্যা ছিল। সে সমস্যাগুলো সমাধানের  উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন বলতে পারি আমরা সেই সব সমস্যার অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার স্বীকৃতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে এই বাহিনীকে প্রথম সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় পতাকা প্রদান করেন। যা বাহিনীটির কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি। 

এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারে এসে আনসার সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, যারা সরকারি কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা আমরা করে দেই। আগে এই বাহিনীর চাকরিতে কোন নিশ্চয়তা ছিল না, ছিল না স্থায়ীত্ব। বর্তমান সরকার ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যদের চাকরি স্থায়ীকরনের পদক্ষেপ নিয়ে এক নিশ্চিত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছে। এই সবকিছুরই কারিগর আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পর্যায়ক্রমে এখন ৬ বছর চাকরি করার পরে এই ব্যাটালিয়নের সদস্যরা  চাকুরিতে স্থায়ী হচ্ছেন। বর্তমান সরকারের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে চাকরির সুযোগ মিলেছে।

মহাপরিচালক একেএম আমিনুল হক বলেন, গত বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষ্যে যারা নিরলস পরিশ্রম করে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ ও অভিন্দন জানাই। সেই সঙ্গে এই বাহিনীর মাসিক পত্রিকা ‘প্রতিরোধে’র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আগামী  ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সম্মেলনের  কর্মসূচী সফল করা, বাহিনীর সার্বিক সাফল্য ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেন। 

আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংশ্লিস্ট কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে আমিনুল হক বলেন, বিভিন্ন দায়িত্ব পালন আপনারা যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। ফলে সদস্য সংখ্যাও যৌক্তিকভাবে আমরা বৃদ্ধি করেছি। আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন, হাউস গার্ড, মডেল ব্যাটালিয়ন, সদর দপ্তরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি উন্নতমানের প্রশিক্ষণ যা মানসম্মতভাবে দায়িত্ব পালনে ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও  লজিস্ট্রিক সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করেন। এসময় তিনি বাহিনীর নারী সদস্যদের বিষয়ে কথা বলেন। 

মহাপরিচালক বলেন, আমাদের নারী সদস্যদের কর্মকাণ্ডে আমরা গর্বিত। তারাও সীমিত সুযোগের মধ্যেও যথেষ্ট অবদান রেখে যাচ্ছেন। তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব তারাও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনসার ভিডিপি’র জন্য একটি ব্যাংক করে দিয়েছেন। যদিও ব্যাংকের এখন নিজস্ব কোনো ভবন নেই। এই ভবন যাতে নির্মাণ হয় এবং আমাদের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো একই জায়গায় যাতে তৈরি হতে পারে সেই ব্যবস্থ্যাটি নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান। 

মহাপরিচালক আরোও বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে গত ২০২২ সাল পর্যন্ত (১৪ বছরে) ৩৫টি জেলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ৫৪ হাজার ২২১ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্যকে কারিগরি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।  যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রেই কেবল নয় দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।  এছাড়া ২০১৫-২০১৬ হতে ২০১৯-২০২০ পর্যন্ত অর্থ বছরে ৫৪টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কেন্দ্রভিত্তিক ১৪ হাজার ৩৮০ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্য সদস্যাকে কারিগরি ও পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ২৩ হাজার ৩০২ জনকে আত্মস্বাবলম্বী করা হয়েছে।

এবি/ জিয়া