হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের দায়সারা তদন্ত

কুশিলবরা রইলেন নিরাপদে

প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৪, ১৪:২৩ | অনলাইন সংস্করণ

  মেহদী আজাদ মাসুম:

# হল-মার্ককে প্রথম ঋণ দিয়েছিল সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই। এই সুযোগ নিয়ে রূপসী বাংলা শাখা হল-মার্ক গ্রুপকে জালিয়াতি করতে সব ধরনের সহায়তা দেয়। কয়েকজন কর্মকর্তা জালিয়াতির কথা জানতে পেরে তা ব্যবস্থা নিলে তাদের বদলি করা হয় এক দিনের নোটিশে।
# সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে লেখা ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। তবে বাস্তব প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। তদন্তের দায়িত্বে থাকা দুদক কর্মকর্তারা তদন্তে আরো গভীরে ঢুকতে পারতেন। তাহলে আরো অপরাধীদের নাম বেড়িয়ে আসতো : বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন


আলোচিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চেয়ারম্যানসহ ১৬ জনকে সাজা দিয়েছেন আদালত। তবে দেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম এ অর্থ লোপাটের ঘটনার কুশিলব সোনালী ব্যাংকের সেসময়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা থেকে গেছেন নিরাপদে। এতবড় ঘটনায় তাদের গায়ে আঁচড় তো দুরের কথা, একটু বাতাসও লাগেনি। এ ক্ষেত্রে দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টদেরই দুষছেন বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করেন, দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জেনেও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ছাড় দিয়েছেন।

গত মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) হল-মার্ক কেলেঙ্কারির মামলায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও গ্রুপ চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরিসহ ৭ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১ এর বিচারক মো. আবুল কাশেম এ রায় দেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হল-মার্ককে প্রথম ঋণ দিয়েছিল সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই। এই সুযোগ নিয়ে রূপসী বাংলা শাখা (সাবেক শেরাটন শাখা) নিয়মিতভাবে হল-মার্ক গ্রুপকে জালিয়াতি করতে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ কর্মকর্তা এই জালিয়াতির সুযোগ করে দেন। জালিয়াতির ঘটনা যাতে উদ্ঘাটিত না হয়, সে ব্যবস্থাও নেয়া হয়। হাতে গোনা কয়েকজন কর্মকর্তা জালিয়াতির কথা জানতে পেরে তা উদ্ঘাটনের ব্যবস্থা নিলে তাদের বদলি করা হয় এক দিনের নোটিশে। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালীদের পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল।

সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা (সাবেক শেরাটন শাখা) থেকে জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ ৩ হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র হল-মার্কই তুলে নেয় ২ হাজার ৬৬৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। একটি ব্যাংকের একটি শাখায় একটি কোম্পানির এই পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে বলে ব্যাংকিং খাতের কেউ তথ্য দিতে পারেননি।

রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এ কে এম আজিজুর রহমান এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তাকে সহায়তা করেছিলেন ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবীরসহ ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাই। আজিজুর রহমান আটক অবস্থায় মারা গেছেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র মতে, স্বাধীনতার পর ব্যাংক খাতে ঋণ কেলেঙ্কারির তালিকা অনেক দীর্ঘ। একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, যার বেশির ভাগেরই কোনো সুরাহা হয়নি। আত্মসাৎ করা অর্থও উদ্ধার হয়নি। তবে নানা কারণে এই তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি। কেলেঙ্কারির সেই ঘটনা ছিল ২০১১ ও ২০১২ সময়ের।

রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি, সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা এবং কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মিলে কীভাবে ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ করা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই হল-মার্ক কেলেঙ্কারি। আবার একটি ব্যাংকের মাত্র একটি শাখা থেকে সর্বোচ্চ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা হিসেবেও এটা সবচেয়ে বড়। বলা যায়, সবার চোখের সামনে থেকেই কেলেঙ্কারির এ ঘটনা ঘটেছিল।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০২৩ এই ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট–বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি।

জানতে চাইলে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমার বার্তাকে বলেন, ‘সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে লেখা ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান।’ তবে বাস্তব প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। আমার মনে হয় তদন্তের দায়িত্বে থাকা দুদক কর্মকর্তারা এই মামলার তদন্তে আরো গভীরে ঢুকতে পারতেন। তাহলে আরো অপরাধীদের নাম বেড়িয়ে আসতো। ’

রায়ের পর্যবেক্ষণ

হল-মার্ক গ্রুপের এমডি ছিলেন তানভীর মাহমুদ আর চেয়ারম্যান ছিলেন তার স্ত্রী জেসমিন ইসলাম। এক যুগ আগের এই ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় করা এক মামলায় গত ১৯ মার্চ (মঙ্গলবার) তানভীর মাহমুদ, জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক আবুল কাসেম। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলো মনে করে, তাদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত বলে আদালত মনে করেন। তবে সংশ্লিষ্ট আইনে এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন, তাই তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।


যারা দন্ডিত হয়েছেন

হল-মার্ক কেলেঙ্কারির মামলার রায়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী এবং গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরিসহ ৭ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া অন্য সাতজন হলেন তানভীরের ভায়রা হল-মার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, সাইফুল হাসান, নকশি নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক ও আবদুল মতিন।

দণ্ডিত বাকি ৮ আসামি হলেন সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার, সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান, প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাইনুল হক, উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সফিজউদ্দিন এবং এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান। এই আটজনের মধ্যে জামাল উদ্দিনের পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বাকিদের ১৭ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।