নকল ওষুধে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি

প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৫৪ | অনলাইন সংস্করণ

  রতন বালো

আওলাদ হোসেন। বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। দক্ষিণ মানিকগঞ্জের পশ্চিম শানবান্ধা গ্রামের খেদানি মাতবরের ছোট ছেলে। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী। বেঁচে থাকার অনন্ত আকুতি নিয়ে হাসপাতালে যান।

গত ১৬ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী স্বজনরা বাজার থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে আনে। কিন্তু রোগ সারে না। কারণ ওষুধটা আসল নয়। ঐদিন রাত ২ টার দিকে রোগী ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এমন ঘটনা একটি-দুটি নয়, বহু। প্রায়ই এমন অনেক নকল ওষুধ ধরাও পড়ে।

প্রশাসনের ঢিলেঢালা নজরদারির কারণে রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ। অভিযান চালিয়ে জরিমানা পর্যন্ত করে থেমে যাচ্ছে প্রশাসন। ফলে এ অপকর্মের মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে নকল ওষুধে বাড়ছে মানুষের মৃত্যুঝুঁকি।
এদিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও কয়েকমাস যাবত সেটিও বন্ধ রয়েছে।

ফলে নকল, ভেজাল ও মানহীন ওষুধে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। ফলে রোগ নিরাময়ের আশায় ওষুধ কিনতে গিয়েও মানুষের মনে নানা সংশয় কাজ করে। ওষুধ ভালো না মন্দ, নকল না আসল, তা যাচাই করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই।

নকল বা ভেজাল ওষুধ যদি জীবন রক্ষার পরিবর্তে জীবন হরণের কারণ হয়, তাহলে তা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই নকল বা ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর বিকল্প নেই। এ রকম অভিযান যে মাঝে মধ্যে চালানো হয় না, তা নয়। অভিযানকালে কিছু নকল বা ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়, আটক করা হয় এর সঙ্গে জড়িতদের।

আবার ওষুধের মোড়ক পরিবর্তন করে জালিয়াত চক্র বিদেশি ওষুধ বলে বিক্রি করছে। এমনকি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও তারা নতুন মোড়কে তারিখ লাগিয়ে বিক্রি করছে। এসব ভেজাল ওষুধ সেবন করে রোগীদের উপকার তো দূরের কথা আরও বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। অনেকেই বেশি দামে ওষুধ কিনে সেবন করেও কাজ হচ্ছে না। আবার নিয়মমত ওষুধ সংরক্ষণ না করায় ওষুধের গুণগত মানও নষ্ট হচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অনুসন্ধান করে এই জালিয়াত চক্রের সন্ধান পেয়েছে। ওই চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, নকল ও মোড়ক পরিবর্তন করা বিপুল পরিমাণ ওষুধ ও ইনজেকশন উদ্ধার করা হয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসা রোডের একটি ফ্ল্যাটে বিভিন্ন ধরনের নকল ওষুধ তৈরি করছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে আশফাক নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় আস্তানা থেকে ৯০ প্যাকেট ইনজেকশন, ২৮ বক্স ইনজেকশনসহ কয়েক ধরনের ভেজাল ইনজেকশন উদ্ধার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃত আশফাক পুরনো ঢাকার মিটফোর্ড পাইকারি ওষুধ মার্কেট থেকে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির তৈরি আইটি ভেক্স ইনজেকশন পাইকারি দামে কেনেন। পরে সুইজারল্যান্ডের তৈরি রোপাই ফেক ৩০০ ইনজেকশনে রূপান্তরিত করে বিক্রি করছেন। এভাবে বিভিন্ন ধরনের নামিদামি ব্র্যান্ডের ওষুধ ও মোড়কের নাম পরিবর্তন করে সুইজারল্যান্ড ও ভারতের বলে মিটফোর্ডের জসিমের কাছে বিক্রি করতেন তিনি।

অভিযুক্ত আশফাকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন এলাকায় অভিযান চালিয়ে জসিমকে  গ্রেপ্তার করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে জসিমের দেয়া তথ্য মতে, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে নকল ইনজেকশন তৈরির স্টিকার ও প্যাকেট সরবরাহকারী শুভ বর্ধনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এ বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি রাজীব আল মাসুদ জানান, নকলবাজ চক্র মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নতুন মোড়ক লাগিয়ে বিদেশি বলে বিক্রি করতেন। গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্য ও স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ওষুধ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও তথ্য উদ্ঘাটনে এখন তদন্ত চলছে।

কয়েকজন ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ওষুধের কাঁচামাল এবং বিদেশি ওষুধের দাম অনেক বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশে তৈরি ওষুধের দামও কয়েকগুণ বেড়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, সংঘবদ্ধ নকলবাজ চক্র যখন যে ওষুধ বেশি চলে সে ওষুধই নকল করে শহর থেকে গ্রামগঞ্জে নিয়ে বিক্রি করে। মিটফোর্ড, জিঞ্জিরাসহ বিভিন্ন এলাকায় গোপন আস্তানায় নকল ওষুধ তৈরি ও প্যাকেটের মোড়ক পরিবর্তন করে মিটফোর্ডে বিক্রি করছে। দোকানের ড্রয়ারে বা গোপন স্থানে বা গোডাউনে রেখে নকল ওষুধ বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে ওষুধ বিশেষজ্ঞ জানান, নকল-ভেজাল ওষুধ বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেকোনো দেশের মানুষের জন্য হুমকি। নিয়মিত তৎপরতার মাধ্যমে বাজার থেকে নকল ওষুধ তুলে নেয়া সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্ব। আর নকল- ভেজাল ওষুধ রোগীদের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

আমার বার্তা/ওসমান