দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষ

প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১১:২৮ | অনলাইন সংস্করণ

  রতন বালো

  • সরকারি তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই
  • সামান্য ডাল-ভাতও দামি খাবার
  • দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও বাড়বে - অর্থনীতিবিদ
  • মাছে ভাতে বাঙালি উক্তিটি আজ বিলুপ্তপ্রায় - মো. আমজাদ হোসেন- কৃষিবিদ 

খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্যের চাপে এখন পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। গরিব মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের বর্তমানে মনে হচ্ছে সামান্য ডাল-ভাতও দামি খাবার। অনেকের পক্ষেই এখন সম্ভব হচ্ছে না তিনবেলা খাবার। অল্প টাকায় দুবেলা খাওয়ার আকুতি তাদের কণ্ঠে। এছাড়াও বেড়েছে বাড়িভাড়া, পরিবহণ ব্যয়, চিকিৎসা ও শিক্ষা উপকরণের দাম। কিন্তু আয় বাড়েনি। ফলে জীবনযাত্রায় বাড়তি ব্যয়ের জাঁতাকলে রীতিমতো পিষ্ট মানুষের জীবন। এসব দেখার যেন কেউ নেই। বিশেষ করে হাঁপিয়ে উঠেছে মধ্যবিত্ত।

এক্ষেত্রে নিম্নবিত্তের মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বিভিন্ন সরকারি সুবিধা পেলেও বাড়তি ব্যয়ের চাপে পড়েছে মধ্যবিত্তরা। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমেছে। অনেককে সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এবং মানুষের আয় বাড়ছে। এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এক বছরে বিশ্বে খাদ্যের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আর এখনই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ না হলে বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। ফলে সামনে আরও দুর্বিষহ সময় অপেক্ষা করছে।

অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও বাড়বে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৪ সালের হিসাবে রাজধানীতে বস্তিবাসীর সংখ্যা ২২ লাখ। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে, অনেক আগেই ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে এ সংখ্যা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপটা তাদের ওপরই সবচেয়ে বেশি।

এ সম্পর্কে সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা প্রফেসর ডা. ফজলুর রহমান বলেছেন, অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করতেও সাহস পাচ্ছে না। গরিব মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা।  তিনি বলেন, শুধু খাবার নয় ওষুধের দামও বাড়ছে। অর্থাৎ যে ওষুধটির দাম আগে ৫ টাকা ছিল এখন তা ৬ থেকে ৭ টাকা। ধনীরা সকালে ও রাতে সাধারণত ভাত খায় না। রুটিসহ অন্যান্য খাবার খায়। কাজেই চালের দাম বৃদ্ধি পেলে তাদের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো গরিব মানুষের। সরকারের ব্যর্থ নীতির কারণেই সবকিছুর দাম বাড়ছে বলে মনে করেন ফজলুর রহমান। এই দাম বৃদ্ধির কারণেই সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে। সব ক্ষেত্রেই লুটপাট চলছে। এটা বন্ধ করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হবে।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির হার ১৫ থেকে ২৪ শতাংশ। সব প্রকার আটার দামও বেড়েছে। প্রায় ১২ শতাংশ। সকল প্রকার তেলের দাম বেড়েছে। সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ শতাংশ। মুগডাল বেড়েছে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত। তবে অন্যান্য ডালের দাম কমেছে। পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৭২ শতাংশ, তবে রসুনের দাম কিছুটা কমেছে। মরিচ, হলুদসহ সব মসলার দাম বেড়েছে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। মাছ, মাংসের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত, তবে বয়লার মুরগির দাম কিছুটা কমেছে। সব দুধের দাম বেড়েছে।

এদিকে সামান্য ডাল-ভাতও এখন মনে হচ্ছে দামি খাবার। অল্প টাকায় দুবেলা খাওয়ার গরিবের একমাত্র আশা। তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে, ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও বাড়বে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ অবস্থা চলতে থাকলে, ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও বাড়বে। তাই নিত্যপণ্যের মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানিতে শুল্কও কমানোর পরামর্শ তাদের। 
গত দুই বছরের শুরু থেকে বাড়তে থাকে চালের দাম। সরকারের নানা পদক্ষেপে, এতে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও তা এখনও স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তারওপর বাড়তি বোঝা হয়ে উঠেছে সবজি, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের মতো নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি।

আগামী বোরো মৌসুম ছাড়া চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। ওই সময় চাল বাজারে আসলেই দাম কমবে। কারণ  দেশে আমন যে পরিমাণ উৎপাদন হয় তাতে বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়ে না। এছাড়া অগ্রাহায়ণের (শীতের এই মৌসুমে) শুরুতে সাধারণত সবজির দাম কম থাকে। কিন্ত এ বছর হয়েছে উল্টো। কারণ পর পর কয়েক দফা বৃষ্টি হওয়ায় কৃষকের সবজি চাষ ব্যাহত হয়েছে। এজন্য বর্তমানে সবজির দাম বেশি। নতুন সবজি উৎপাদনে সময় লাগায় সবজি বিশেষ করে তরিতরকারির দাম কমতেও সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

কৃষিবিদ মো. আমজাদ হোসেন বলেছেন, মাছে ভাতে বাঙালি উক্তিটি আজ বিলুপ্তপ্রায়। আমরা বাঙালি, আর বাঙালিদের হাজার বছরের প্রচলিত একটি কথ্য হলো, আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রধান খাবার হিসেবে সাধারণত ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার বেশি পরিচিত। বিশ্বে আমরাই একমাত্র জাতি যারা প্রধান খাবার হিসেবে ডাল-ভাতকে বেছে নিয়েছি। কিন্তু বাঙালির প্রচলিত সেই মাছে ভাতে বাঙালি উক্তিটি আজ বিলুপ্তপ্রায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষদের স্বল্প আয়ের একটি উন্নয়নশীল দেশ।

তিনি আরো বলেন, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর। যেখানে নিজেদের সামান্য উপার্জনের টাকায় নিজের পরিবার ও সন্তানদের খরচ যোগানো ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার সেখানে অতিরিক্ত দামে চাল ক্রয় করে পরিবারের সদস্যদের খাবারের যোগান দেয়া কি আদৌ সম্ভব? একজন খুব সাধারণ শ্রমিক, সে প্রতিদিন তার পারিশ্রমিক হিসেবে পায় ২০০-২৫০ টাকা। এখন সে যদি কেজিপ্রতি ৬৫ টাকা দরে চাল কিনে তাহলে পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনাসহ অন্যান্য সদস্যদের খাওয়া-দাওয়া, পোশাক, চিকিৎসা ইত্যাদি খরচ সে কীভাবে বহন করবে? বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সরকারের নজর দিতে হবে।

কৃষি বিশেষজ্ঞ রমজান মিয়া জানান, আমাদের আশপাশের যে মানুষগুলো টাকার অভাবে চাল কিনতে না পেরে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে তাদের ত্রাণ দিবে? চালের দাম কেন, কীভাবে বেড়েছে? এর পিছনে কাদের ষড়যন্ত্র এগুলো আমরা সাধারণ মানুষ বুঝতে চাই না। জানতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আমাদের একটাই অনুরোধ আমরা গরিব মানুষ শান্তিতে পেট ভরে যেন ২ বেলা ২ মুঠো খেতে পারি। আগামীবছর ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নতুন সরকার দেশ পরিচালণার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তাদের প্রতি অনুরোধ খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্যের দিকে নজর দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতি নজর দিয়ে নিত্যপণ্যের মূল্যের হ্রাসের প্রতি নজর দেয়ার জোড় আহবান জানান।